প্রাক্তন এক রাশিয়ান গুপ্তচরের কিছু কথা।

ইউরি বেজমেনভ একজন রাশিয়ান গুপ্তচর। স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে, ১৯৭০ সালে তিনি রাশিয়া থেকে আমেরিকা ডিফেক্ট করেন।
১৯৮৪ সালে দেয়া তার একটা বিখ্যাত লেকচার আছে, যেই খানে তিনি কেজিবি কিভাবে, গুপ্তচরবৃত্তিতে সাবভারশান ব্যবহার করে, তার একটা চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি বলছেন, অনেকে মনে করে,একটা দেশে কি অস্ত্র সস্ত্র আছে, গোপন তথ্য চুরি, গোপন স্থাপনার খবর নেয়া- এই গুলো হচ্ছে গুপ্তচর বৃত্তি। উনি বলছেন, এই গুলো হলিউডি জেমস বন্ড টাইপের ধারনা। কিন্ত এর কোন বাস্তবতা নাই।
তিনি বলেছেন, গুপ্তচর বৃত্তির সর্বোচ্চ আর্ট হচ্ছে, সাবভারশান। যেইটা গুপ্তচরবৃত্তির আল্টিমেট পারপাস, যা একটা গুলি ছোড়া ছাড়াই অর্জন করা যায়। সাবভারশানের মুল কাজ গুলো বৈধ। এবং এইটা রাষ্ট্রের নিজের নাগরিকদেরকে দিয়েই অর্জন করা যায়। গুপ্তচর লাগেনা।

তিনি বলছেন, সাবভারশনের চারটা স্টেজ আছে,
১। ডিমরালাইজেশান।
এই ডিমরালাইজ করতে ১৫ থেকে ২০ বছর লাগে। কেন ২০ বছর লাগে ? তিনি বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে একটা জেনারেশানের চিন্তাকে শেপ করা যায়, তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা যায়।
ডিমরালাইজেশানে থাকে, ইনফিল্ট্রেশান বা প্রোপাগান্ডা। যার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে, ছয়টা জিনিষকে আক্রমন করা হয়

ক। ধর্ম। ধর্মীয় ভ্যালুকে ধ্বংস করা।

খ। এডুকেশান । শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে, প্রকৃত জ্ঞানকে ধ্বংস করা হয়। সাইন্স, ফিজিক্স,বিদেশী ভাষা , ক্যামিস্ট্রি , ম্যাথমেটিক্সের বদলে ইতিহাস, যুদ্ধ, হোমইকনমিক্স, যৌন শিক্ষা ইত্যাদির উপরে গুরুত্ব নিয়ে আসা হয়।

গ। সামাজিক জীবন।
স্বাভাবিক সামাজিক জীবনকে ধ্বংস করতে রাষ্ট্রের মধ্যে আদর্শিক বিরোধ তৈরি করা হয়। এবং এমন একটা সমাজ সৃষ্টি করা হয়, যেখানে আদর্শিক কারনে ক্রিমিনালকে সমাজ আর ক্রিমিনাল বলবে না,ক্রিমিনালকে কিছু লোক বা সমাজের বড় একটা অংশ শ্রদ্ধা করবে।

ঘ। ক্ষমতার বিন্যাস
জনগণের ইচ্ছায় ক্ষমতা নিরধারনকে ধ্বংস করে, অস্ত্র এবং শক্তি দিয়ে ক্ষমতার আরোহণ অবরোহণের পথ তৈরি করা হয়। আরটিফিসিয়াল ক্ষমতা তৈরি করে অযোগ্য নেতৃত্বকে অধিষ্ঠিত করা হয়, যে বলে দিবে, কে ভালো কে খারাপ। সমাজ নিজে থেকে ভালো খারাপ আর নিধারন করতে পারেনা।

ঙ। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক,
মালিক শ্রমিক সম্পর্কে বারগেনের বা নেগশিয়াশানের জায়গা নষ্ট করে, মালিক পক্ষের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়। বারগেনের মাধ্যমে কম্প্রমাইজের পরিবেশ নষ্ট করে, মালিক শ্রমিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস এবং ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়।
এবং শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধি পেলেও, শ্রমিকরা যেন লিভিং ওয়েজ পেতে না পারে সেইটা নিশ্চিত করা হয়।

চ। ল এন্ড অর্ডার ।
মানুষের বিচার পাওয়ার , কনফ্লিক্ট রেজুলিউশান হওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়, যেন, মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।
এই কাজ গুলো করে, দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে ডিমরেলাইজ করা হচ্ছে, এই ফেজের উদ্দেশ্য। বেজমেনভের মতে এই কাজ গুলো কিন্ত, গুপ্তচরেরা করেনা। এই কাজ গুলো কিন্ত দেশের নাগরিকদের হাতেই সম্পন্ন করা হয়।

২। ডিমরালাইজের পরের স্টেজ হচ্ছে, ডিস্টাবাইজেশান।
এই পর্যায়ে গিয়ে দেশে আর কোন কনফ্লিক্ট রেজুলেশান হয়না। নিজেদের মধ্যে সংঘাত বিরোধ এবং মারামারি বাদে কেউ কম্প্রোমাইজ করতে পারেনা,।
এই সময়ে হিউম্যান রিলেশানকে র‍্যাডিকালাইজ করা হয়। টিচারের সাথে ছাত্র, মালিক শ্রমিক সম্পর্ক, যাত্রির সাথে পরিবহন শ্রমিকের সম্পর্ক সকল লেভেলে একজন আরেকজনকে ঘৃণা করবে।
এই সময়ে মিলিটারাইজেশান ও হবে। এমনকি নাগরিকের মধ্যেও মিলিটারাইজেশান হবে। সামান্য ইসুতে একজন আরেক জনকে শুট করবে। মিডিয়াকে নাগরিক তার প্রতিপক্ষ মনে করবে।
নাগরিকের অধিকারের বদলে, অপ্রয়োজনীয় আদর্শিক ইস্যুকে রাষ্ট্রের প্রধান ইস্যুতে পরিণত করা হবে, যেই গুলো নিয়ে নাগরিক নিজেদের মধ্যে মারামারি করবে।
এই সময়ে বিভিন্ন আরটিফিশিয়াল এন্টিটি ক্ষমতা দাবী করবে। এবং রাষ্ট্র তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে ক্ষমতার হালুয়া রুটির ভাগ দিবে।

৩। ক্রাইসিস।
থার্ড স্টেজে এসে পপুলেশান এখন সমাধান খুজবে। একটা শক্তিশালী সরকার খুজবে। একজন নেতা খুজবে, যে রাষ্ট্রের এই সমস্যা গুলোকে সমাধান করতে পারবে।
এই নেতাকে অপরিসীম ক্ষমতা দেয়া হবে। নইলে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পরার বা সিভিল ওয়ারের ভয় থাকবে।

৪। নরমালাইজেশান।
এই নেতা রাষ্ট্রের এই নেতা কঠোর ভাবে, আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রন করবে। তিনি স্টাবিলিটির নাম দিয়ে, সব কিছু নিজস্ব বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রন করবে। কিন্ত, সমাজের আর কারো , তার কোন কিছুর বিরোধিতা করার সুযোগ থাকবেনা।
এই সময়ে আর কোন স্ট্রাইক হবেনা। সবাই একটা ফ্রিডমের ভাবের মধ্যে থাকবে। কিন্ত, তার আর কোন স্বাধীনতা থাকবেনা। সব কিছু ভেঙ্গে পরলেও সবাই নীরব থাকবে। সবাই, একটা ডিজফানশনাল জীবন যাপন করবে কিন্ত, সেইটাকে নরমাল ভাববে।

ইন্টেরেস্টিংলি, লিঙ্কে দেয়া ১৯৮৪ সালের এই ভিডিওটিতে বেজমেনভ, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকেও উদাহরন হিসেবে এনেছে।
একজন রাশিয়ান ডিফেক্টর হিসেবে তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ান নিয়ে অনেক ঘৃণা আছে এই ভিডিওতে। ফলে, সেই দিকে আমরা যাবোনা। কিন্ত, বেজমেনভের এই তথ্য গুলো দিয়ে স্নায়ু যুদ্ধের সময়ের পৃথিবীর আন্ত রাষ্ট্রীয় এস্পিয়নাজকে বোঝা যায়।
বলাই বাহুল্য, স্নায়ু যুদ্ধের পরে, এখন এই গুলোর আর কোন প্রয়োগ নাই। তবুও আমরা একাডেমিক আলোচনার জন্যে বিষয় গুলো জানলাম।
কেউ বর্তমান বাংলাদেশের সাথে এর তুলনা করবেন না। কারণ, আবার বলছি এইটা একটা একাডেমিক আলোচনা। যদিও একাডেমিক আলোচনার খাতিরে, চিন্তার করার সুযোগে আছে, বাংলাদেশ, বর্তমানে, ডিমরালাইজ স্টেজে আছে নাকি নরমালাইজ স্টেজে আছে। কিন্ত, এই ধরনের কস্ট কল্পনা করে, বা বর্তমান জিপিএ ফাইভের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করাটাকে সাবভাসিভ এক্টিভিটি হিসেবে তুলনা করলে, আপনি নিশ্চিত আমার ব্লক খাবেন। আপনার কস্ট কল্পনার দায় আপনার।
আমি জাস্ট একটা একাডেমিক আলোচনা করলাম, যার কোন কথাই আমার নিজের বানানো নয়, একটা ভিডিও থেকে নেয়া। ভিডিওটা লিঙ্কে।

 

মন্তব্য ফেবুতে করেন। 

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *