প্যারাডাইম শিফট ও মুসলমানদের ধর্ম প্রচার

জ্ঞান হল মানব জাতির সামাজিক সম্পদ। মানব প্রজাতি প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব আমরা বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করি।
এমন একজন মানুষও নেই যে দাবি করতে পারে যে একটি বোয়িং ৭০৭ বিমানের সমগ্র বস্তুর যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান সে একাই জানে। এ দুনিয়া ও তার স্রষ্টার জ্ঞানের ব্যাপারটি তো আরো দূরের ব্যাপার! যারা খোলা মনের ও প্রশান্ত আত্মার অধিকারী এবং নিজেকে সব জান্তা ভেবে অযথা অহংকারে লিপ্ত না হয় একমাত্র তাদের পক্ষে এ বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ।

মানবজাতির ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহে সেদিন ইউভাল নুহা হারারির লিখিত “সেপিয়েন্স – মানবজাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-A brief history of Humankind” বইটি পড়ছিলাম। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এটি একটি বেস্ট সেলার পুস্তক এবং এ বইটিতে প্রারম্ভিক মন্তব্য করেছেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, বিল গেটস ও জেরার্ড ডায়মন্ড এবং নিউইয়র্ক টাইমস সহ আধুনিক বিশ্বের প্রভাবশালী মহলের বিভিন্ন ব্যক্তিরা।

তবে হারারির এ বইটি মূলত বিবর্তনবাদের সূত্র ধরে ও প্রচলিত সকল ধর্ম চিন্তার বাহিরে লিখিত বলে মানব ইতিহাসের সনাতনী ইসলামী ধর্মীয় বিশ্বাসী অনেকের মনেও খটকা লাগতে পারে। তবে আপনি যদি বাক্সবন্দী ব্যাখ্যার বাহিরে একটু বৃহত্তর পরিসরে অর্থাৎ বিগার পিকচার সামনে রেখে এসব তথ্যের সাথে ইসলামকে জ্ঞান ভিত্তিক চর্চা করে পর্যলোচনা করেন একমাত্র তখনই এ সব উপস্থাপনায় ছিদ্র কোথায় এবং এর পিছনের উদ্দেশ্য কি তা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে সে প্রচেষ্টা তেমন নাই বললেই চলে! আর এসব পন্ডিতেরা যখন তখন ইচ্ছামত ভিডিও তৈরি করে বলতে থাকবেন কোরআনেই সব সমস্যার সমাধান বলে কয়েকটি আয়াত এনে বক্তৃতা দিয়েই ভাবেন কেল্লা খতম! আর ইসলাম পরাজিত হয়ে আছে বলে যারা মনক্ষুন তারাও করছে বিরাট ভূল। ইসলাম পরাজিত হয়নি পরাজিত হয়েছে ইসলাম বিশ্বাসী বলে দাবিদার মুসলিমরা। মুসলিমরা পরাজিত ভাবছে এজন্য যে বিশ্বে তাদের কোন প্রভাব নাই। কিন্তু আজকের বিশ্ব আর আগের বিশ্ব তো এক নয়। আজকের বিশ্বের যে প্যারাডাইম শিফট হয়েছে তা তো বুঝতে হবে। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে তার আগে ফিরে যাই আবার হারারি বইয়ের বিষয়ে।

হারারি তার বইয়ে বর্ণিত ইতিহাসে লক্ষ হাজার বছরের পুরানো মানবদেহের কিছু হাড় বা কঙ্কাল ও ফসিল ইত্যাদির নৃতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও গবেষনাকে ভিত্তি করে ও সে সব তথ্যের সহায়তায় নিজের চিন্তায় ঘরে বসে কল্পনা করে যে এক ইতিহাস লিখেছেন তা খুবই চমৎকার। তিনি এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন যেন সেটিই বাস্তব এবং বৈজ্ঞানিক সত্য যা তিনি নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছেন। আর বিষয়গুলোর উপস্থাপন এমনভাবে করেছেন যে পাঠককে বইটি পড়ায় প্ররোচিত করে। তার বইয়ে ৩৬ পৃষ্টায় লিখেছেন, ” মানুষ যখন এক পর্যায়ে ভাষার মাধ্যমে একটি কল্পনাপ্রসূত বাস্তবতার স্বপ্ন দেখাতে শিখল তখন থেকে বিপুল সংখ্যক অপরিচিত মানুষ একসাথে কার্যকর সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়। It also did something more. Since large-scale human co-operation is based on myths, the way people cooperate can be altered by changing the myths- by telling different stories. Under the right circumstances myth can change rapidly. In 1789 the French population switched almost overnight from believing in the myth of divine right of Kings to believieving in the myth of sovereignty of people.
বইটিতে দ্বিমত হওয়ার অনেক কিছু যেমন আছে তেমনি অনেক তথ্য আছে মানব সভ্যতার পরিবর্তনের বিষয়ে যা চিন্তার খোরাক জাগায়। তবে সে সব তথ্যের ভিত্তিতে যে সব থিওরির উত্তান হয়েছে বৈজ্ঞানিক মহলে সে বিষয়েও বিতর্কিত আছে।

দু:খের ব্যাপার হল মানুষ আজ স্রষ্টার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করাটাই অনেকে বিজ্ঞান বলতে চায় অথচ স্রষ্টার প্রতি মানুষের ফিৎরা বা সহজাত প্রকৃতির সেই অনুভূতিকে তারা কোন মূল্য দিতে চায় না!

বিবর্তন আসলে পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির মাঝে বিদ্যমান এবং সে প্রক্রিয়া চলে আসছে প্রকৃতির সৃষ্টির শুরু থেকে । বিবর্তন বিদ্যমান অণু-পরমাণুতে যা অবিশ্বাস করার উপায় নাই জ্ঞানীদের পক্ষে। এমন কি ভাইরাসের মাঝেও বিবর্তন হয় যেমন আজকাল চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন,করোনা ভাইরাসটি মানব দেহকোষের ভেতরে ইতিমধ্যেই একাধিকবার মিউটেট করেছে অর্থাৎ নতুন রূপ নিচ্ছে!

তবে অনেকই জানেন যে ডারইউনের বিবর্তন তত্ত্ব (Evolution Theory) শুরুতে যে ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল বর্তমানে বৈজ্ঞানিক মহলে তার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে বিভিন্ন গবেষণায়।
আর এ বিবর্তনের পিছনে কোন দৈবিক শক্তির বা ইনটেলিজেন্ট ডিজাইনারের সুনিপুণ কর্মপদ্ধতির ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার চলছে কিনা সেটি বিজ্ঞানী মহলে যারা আমলে নিতে চাননা তারা মূলত নাস্তিকতা প্রচারের প্রাতিষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ।

একইভাবে ধর্মীয় অঙ্গনে এক শ্রেণীর মানুষের নিজস্ব ব্যাখ্যাকে বিশ্বাসকে চূড়ান্ত ও চিরসত্য মনে করে বৈজ্ঞানিক মহলে আলোচিত কোন বিষয় বা আবিষ্কারকে বিবেচনায়ই আনতে চান না।

তবে আজকের বিশ্বে প্যারাডাইম শিফটের কারণে ধর্ম ব্যাখ্যার পুরানো কায়দা যে কাজ হবেনা সেটি বুঝার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনের স্কলারদের হচ্ছে কিনা সেটিই হচ্ছে বড় প্রশ্ন? প্যারাডাইম হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক এবং অনিবার্য ব্যাপার সেটি বুঝা আমাদের খুবই দরকার।
সে যাক, কখনও কখনও আমাদের পক্ষে এই প্যারাডাইম বুঝা বাস্তবতা থেকে এতটা দূরে সরে যায় যে তখন সকল প্রচেষ্টা অকার্যকর হয়ে যায়! আসলে এই প্যারাডাইম শিফট বুঝা যখন ঘটে তখন সেটি এ পৃথিবীকে নতুন আলোতে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে দেয়। কখনও কখনও এটি হঠাৎ ঘটে, এবং কখনও কখনও খুব ধীরে ধীরে।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপের এক শ্রেণীর লোকেরা বিশ্বাস করত এবং সেটি তারা বৈজ্ঞানিক সত্য বলেও মনে করত তা হচ্ছে যে শ্বেতাঙ্গ চেহারার মানুষেরা (White race) এশিয়া আফ্রিকান কালো মানুষের চেয়ে জৈবিকভাবে (biologically) ভালো জাতের মানুষ ও উত্তম জাতি অর্থাৎ white supremacy! জার্মানির হিটলারও তা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এখন প্রমাণিত সত্য দেখা যায় সে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল এবং অবৈজ্ঞানিক। আজ সময়, সুযোগ ও অবস্থা সাপেক্ষে কালা বা বাদামি চেহারার মানুষেরাও যে কোন অংশে কম নয় সে বাস্তবতা মানুষ দেখছে।

মোটিভ্যেশন্যাল লেখক স্টিভেন কোভি একটি মিনি-প্যারাডাইম শিফটের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন তার (The 7 Habits of Highly Effective People) বইয়ে। সেটি তিনি এভাবে বর্ণনা করেছিলেন যে,
“এক দিন আমি সকালে নিউ ইয়র্কের “সাবওয়ে” (পাতাল রেলপথ) একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ট্রেইনে মানুষ চুপচাপ বসে ছিল – কেউ সংবাদপত্র পড়ছে, কেউ চিন্তায় হারিয়ে গেছে, কেউ চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছে। এটি ছিল একটি শান্ত, শান্তিপূর্ণ দৃশ্য। তারপর হঠাৎ, একজন মানুষ এবং তার বাচ্চাদেরকে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল। বাচ্চারা এত জোরে কথা বলছিল এবং দুরন্ত দুষ্টামী করছিল যে তাত্ক্ষণিকভাবে একটি শান্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে তারা পুরা বদলে দিল। কিন্তু তাদের বাবা সিটে বসে চোখ বুজে ঘুমিয়ে থাকার মত নিরব ছিলেন। ইতিমধ্যে বাকি যাত্রিদের সবাই অত্যন্ত তিক্ত বিরক্ত হয়ে মনে মনে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে তা বুঝা যাচ্ছিল। আমি সহ্য করতে না পেরে লোকটিকে নাড়া দিয়ে বললাম হে জনাব, আপনি কেন বাচ্চাদেরকে দুষ্টামী বন্ধ করতে নাবলে নিরব বসে আছেন? এরা যে সবাইকে বিরক্ত করছে তা কি দেখতে পাচ্ছেন না? লোকটি চোখ খুলে যেন প্রথমবারের মতো পরিস্থিতি আচ করে মৃদুস্বরে বলল “ওহ আপনি ঠিকই বলেছেন. আমার মনে হয় এটা নিয়ে আমার কিছু করা উচিত ওদেরকে থামাতে হবে।

আসলে ভাই ব্যাপার হচ্ছে আমরা এই মাত্র হাসপাতাল থেকে এসেছি যেখানে প্রায় এক ঘন্টা আগে তাদের মা মারা গেছেন। আমি এখন কোন কিছু চিন্তা করতে পারছিনা কি করব, এবং মনে হয় বাচ্চারাও জানেনা কীভাবে এটি সামলাতে হয়।” আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে আমি (কোভি) সেই মুহূর্তে কি অনুভব করেছিলাম?
সাথে সাথে আমার প্যারাডাইম শিফট হয়ে গেল! হঠাৎ আমি তখন জিনিসগুলিকে অন্যভাবে দেখতে লাগলাম, এবং যেহেতু আমি ভিন্নভাবে দেখেছি, আমি ভিন্নভাবে চিন্তা করেছি, আমি অন্যরকম অনুভব করেছি, আমি ভিন্নভাবে আচরণ করেছি। আমার বিরক্তি দূর হয়ে গেল।”

প্যারাডাইম শিফট প্রসঙ্গে স্টিভেন কোভির এ গল্পটি এ জন্য লিখলাম যে আজ মুসলমানদের উচিৎ দুনিয়া কোন দিকে যাচ্ছে মানুষ কেন ধর্ম ছাড়ছে এবং দুনিয়ার বাস্তবতাটি কি সে বিষয়টি বুঝা আর তা বুঝতে না পারলে সম্ভব হবে না ইসলামের দাওয়াতি কাজ কি ভাবে করবেন তা ঠিক করা । আর তখন ভিন্নমতের কারো কোন কথা শুনলেই উত্তেজিত হাওয়া ছাড়া উপায় থাকবেনা!

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *