প্যারাডক্সিক্যাল_সাজিদ প্রথম পর্ব


বিশ্বাসের কথা কতটা শক্ত করে বলা যায়?
বিশ্বাসী প্রাণের সুর কতটা অনুপম হতে পারে? বিশ্বাসকে যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপা কি খুব সহজ? অবিশ্বাসীকে কতটা মায়াভরা স্পর্শে বিশ্বাসের শীতল পরশ দেয়া যায়? যুক্তিতেই মুক্তি নাকি বিশ্বাসের যুক্তিতে মুক্তি? ‘প্যারডিক্সিক্যাল সাজিদ’ পড়ে এসবের উত্তর মিলতে পারে।
⭐ প্রকাশকের কথা
সভ্যতার শুরু থেকেই সত্য ও মিথ্যার ধারাবাহিক লড়াই। মানবতার সমাধান ইসলাম বরাবরই জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকদের অপপ্রচার ও বিদ্বেষ মােকাবেলা করে আসছে। আধুনিক সভ্যতার এই সময়ে দাঁড়িয়েও সেই ধারা অব্যাহত আছে। স্যোসাল মিডিয়ার ক্রমবর্ধমান পরিসরকে ব্যবহার করে ইসলামদ্রোহী শক্তি সুকৌশলে তরুন প্রজন্মের চিন্তার রাজ্যে সন্দেহের বীজ বােপন করছে। সন্দেহ থেকে সংশয়, সংশয় থেকে অবিশ্বাস। এভাবে এক অবিশ্বাসী প্রজন্মের গোঁড়াপত্তন হচ্ছে কিবাের্ডে। কিছু অযাচিত বুলি শিখে, প্রশ্নের ডালি নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বাসীদের সুশৃংখল চিন্তার দুনিয়ায়। কিছু কিছু তরুন-যুবা দিকভ্রান্তও হচ্ছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতে। অবিশ্বাসীদের আপাত চমকপ্রদ প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জের মােকাবেলায় হিমশিম অবস্থা। জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ যেখানে, সেখানেই বিশ্বাসী প্রাণের যৌক্তিক লড়াই। এমনই এক বিশ্বাসী তরুন আরিফ আজাদ। অনলাইন দুনিয়ায় অবিশ্বাসীদের উখিত প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিয়ে অজস্র মানুষের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। একজন তরুন এত চমৎকার ও যৌক্তিক ভাষায় ইসলামবিরােধীদের জবাব দিতে পারেন, ভাবতেই আশাবাদী মন জানান দেয়- আগামীর দিন শুধু সম্ভাবনার। ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ বইটিতে গল্প ও সাহিত্যরস দিয়ে অবিশ্বাসীদের নানান প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে। অনুভব করেছি আরিফ আজাদের কথাগুলাে অনলাইন দুনিয়ার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের বাস্তব দুনিয়ায়ও থাকা উচিত। নাস্তিক্যবাদ ও ইসলামদ্রোহীদের অপপ্রচারের জবাবে অনেকেই লিখছেন, বলছেন। এই বইটি সেসব জবাবের ভিত্তিকে আরাে মজবুত করবে। আমার বিশ্বাস বইটি তরুণ প্রজন্মের মনােজগতে এক তুমুল আলােড়ন তুলবে। আশা করি বইটি পড়ে অবিশ্বাসীরাও নির্মোহভাবে ইসলাম নিয়ে চিন্তা করবেন। গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স এই অসাধারন বইটি প্রকাশ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। স্যোসাল মিডিয়ায় লেখাগুলােকে পাণ্ডুলিপি আকারে পাঠকদের হাতে তুলে দেয়ার কাজটা অনেক চ্যালেঞ্জের। বইটিকে যথাসম্ভব সুন্দর ও নিখুত করতে আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের কোন ত্রুটি ছিল না। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আমাদের যােগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে বিশ্বাস করছি। লেখকের স্বকীয়তা এবং ভাষার বৈচিত্র বিবেচনায় প্রয়ােজনে ইংরেজী শব্দও উল্লেখ করা হয়েছে। বানানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নজর দেয়া স্বত্ত্বেও কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে। যেকোন সংশােধনীকে আমরা স্বাগত জানাবাে। পরবর্তী সংস্করণে বইটিকে আরাে সুন্দর ও ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করবােইনশাআল্লাহ। সম্মানিত লেখকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বইটি আমাদের বিশ্বাসের প্রাচীরকে আরাে মজবুত করুক। ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বাসের কথা প্রতি জনে, প্রতি প্রাণে।
৯ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং
নূর মােহাম্মাদ আবু তাহের

,⭐লেখকের কথা
সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে যুগ আর মানুষের চাহিদা। সাথে সাথে মানুষের মধ্যে জানার আকাঙ্খাটাও বেড়েছে অনেক। পরিবেশ, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম- সবকিছু নিয়ে আমরা এখন সদা তৎপর। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি সবাই। এই চলার পথে নানান মানুষের, নানান মতের সাথে পরিচিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। এই মত, পাল্টা মতের বিচার-বিশ্লেষণ, দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারাে বিশ্বাস পাল্টে যাচ্ছে, কারাে বা সুদৃঢ় হচ্ছে আগের চেয়ে। এমনই সময়ের বাঁকে, ইন্টারনেট আর প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা নতুন অনেক কিছুই জানছি, যা হয়তাে আগে জানতাম না। এই জানাটা আমাদের কাউকে আত্মবিশ্বাসী করছে, কাউকে করছে সংশয়বাদী। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে নানান প্রশ্ন। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়, কিলবিল করে এসব প্রশ্ন! এটা কি সত্যিই এরকম? এটা এমন কেননা? এটা আসলে কি হতে পারে? এই জাতীয় নানান রকম প্রশ্নবাণে আমরা প্রায়ই জর্জরিত হই। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে আমিও নিজেও এসবের মুখােমুখি হই। এসবের উত্তর খুঁজতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি। জ্ঞানরাজ্যে পদার্পন করি জানার-শেখার আশায়। একসময় ভাবলাম, এই প্রশ্নগুলাে তাে আমার একার নয়, আমার মতাে অনেকের। আমি যতােটুকু জেনেছি আর বুঝেছি তা অন্যদের জানিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে গিয়ে একসময় কলম হাতে নেমে পড়ি। আমি সম্পূর্ণ জানি না। অনেক কিছুই আমার অজানা। তবে, যেটুকু আমি জেনেছি তা অন্যদের জানাতে আমি সামনে নিয়ে এলাম সাজিদ’ কে। সাজিদ তার সাধ্যমতাে প্রশ্নগুলাের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। সাজিদ জানে তার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবুও সে তার সামর্থের সবটুকু দিয়ে বলে যায়। এভাবেই সাজিদ এগিয়ে যায়। লেখাগুলাে কখনাে মলাটবদ্ধ হবে তা আমি ভাবিনি। এই লেখা মলাটবদ্ধ হবার পেছনে যার অনুপ্রেরণা, ভালােবাসা আর সহযােগিতা। অপরিসীম, সেই শ্রদ্ধেয় নাসির ভাইকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। নবীন একজন লেখকের বই প্রকাশ করে গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স আমাকে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা সম্মানিত পাঠকবৃন্দকে বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই প্রয়াশটুকু যাদের জন্য, বইটি যদি তাদের সামান্য উপকারেও আসে, তবেই আমার-আমাদের শ্রম সার্থক হবে।
আরিফ আজাদ
চট্টগ্রাম

একজন অবিশ্বাসীর বিশ্বাস আমি রুমে ঢুকেই দেখি সাজিদ কম্পিউটারের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। খটাখট কী যেন টাইপ করছে। আমি জগ থেকে পানি ঢালতে লাগলাম। খুব বেশি তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাবার জোগাড়। সাজিদ কম্পিউটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- “কি রে কিছু হলাে? আমি হতাশ গলায় বললাম- নাহ! -“তার মানে তােকে তাহলে এক বছর ড্রপ দিতেই হবে?’ সাজিদ জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম-কি আর করা। আল্লাহ যা করেন ভালাের জন্যই করেন। সাজিদ আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাল। এরপর বলল-“তােদের এই এক দোষ, বুঝলি? দেখছিস পুওর অ্যাটেন্ডেন্সের জন্য এক বছর ড্রপ খাওয়াচ্ছে, তার মধ্যেও বলছিস, আল্লাহ যা করেন ভালাের জন্যই করেন। ভাই, এখানে কোন্ ভালােটা তুই পাইলি, বলত? আগে সাজিদ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া দরকার। আমি আর সাজিদ রুমমেট। সে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রো বায়ােলজিতে পড়ে। প্রথম জীবনে সে খুবই ধার্মিক ছিল। নামাজ-কালাম পড়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কীভাবে যেন অ্যাগনােস্টিক হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে স্রষ্টার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে এখন পুরােপুরি নাস্তিক হয়ে গেছে। ধর্মকে এখন সে স্রেফ আবর্জনা জ্ঞান। করে। তার মতে পৃথিবীতে ধর্ম এনেছে মানুষ। আর ঈশ্বর’ ধারণাটাই স্বার্থান্বেষী কোনাে মহলের মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পনামাত্র। সাজিদের সাথে এই মুহূর্তে তর্কে জড়াবার কোনাে ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু তাকে একদম উপেক্ষা করেও যাওয়া যায় না। আমি বললাম আমার সাথে তাে এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারতাে, ঠিক না?” -“আরে, খারাপ হওয়ার আর কিছু বাকি আছে না কি? – হয়তাে। – যেমন? – এরকমও তাে হতে পারত। ধর, আমি সারা বছর একদমই পড়াশােনা করলাম না। পরীক্ষায় ফেল মারলাম। এখন ফেল করলে আমার এক বছর ছন্দ হয়ে যেত। হয়তাে ফেলের অপমানটা আমি মেনে নিতে পারতাম না। আত্মহত্যা করে বসতাম।’ সাজিদ হা হা হা করে হাসা শুরু করল। হাসি শেষ হতে না হতেই বলল, কী বিদঘুটে বিশ্বাস নিয়ে চলিস রে ভাই। এই বলে সে আবার হাসা শুরু করল। বিদ্রুপাত্মক হাসি। রাতে সাজিদের সাথে আমার আরও একদফা তর্ক হলাে। সে বলল- আচ্ছা, তােরা যে স্রষ্টায় বিশ্বাস করিস, তা কীসের ভিত্তিতে? আমি বললাম-“বিশ্বাস দু ধরনের। একটা হলাে, প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বাস। অনেকটা ঠিক শর্তারােপে বিশ্বাস বলা যায়। অন্যটি হলাে প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস।’ সাজিদ আবারও হাসল। সে বলল-“দ্বিতীয় ক্যাটাগরিকে সােজা বাংলায় অন্ধ বিশ্বাস বলে রে পাগল, বুঝলি? আমি তার কথায় কান দিলাম না। বলে যেতে লাগলাম-প্রমাণের ভিত্তিতে যে বিশ্বাস, সেটা মূলত বিশ্বাসের মধ্যে পড়ে না। আর বিশ্বাসের মধ্যে পড়লেও তা খুবই টেম্পােরারি। এই বিশ্বাস এতই দুর্বল যে, এটা হঠাৎ হঠাৎ পাল্টায়। সাজিদ এবার নড়েচড়ে বসল। সে জিজ্ঞেস করল-“কী রকম? আমি বললাম-“এই যেমন ধর, সূর্য আর পৃথিবীকে নিয়ে মানুষের একটি আদিম কৌতূহল আছে। আমরা আদিকাল থেকেই এদের নিয়ে জানতে চেয়েছি, ঠিক না? -“হু, ঠিক। -“আমাদের কৌতূহল মেটাতে বিজ্ঞান অতীতেও আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে এবং এখনাে করে যাচ্ছে, ঠিক? -হ্যাঁ।-“আমরা একাট্টা ছিলাম। আমরা নির্ভুলভাবে জানতে চাইতাম যে, সূর্য আর পৃথিবীর রহস্যটা আসলে কী। সেই সুবাদে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা নানান সময়ে নানান তত্ত্ব আমাদের সামনে এনেছেন। পৃথিবী আর সূর্য নিয়ে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন। গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি। টলেমি কী বলেছিল সেটা নিশ্চয় তুই জানিস। সাজিদ বলল-“হ্যাঁ। সে বলেছিল সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘােরে। একদম তাই। কিন্তু বিজ্ঞান কি আজও টলেমির থিওরিতে বসে আছে? না, নেই। কিন্তু তুই কি জানিস এই টলেমির থিওরিটা বিজ্ঞান মহলে টিকে ছিল পুরাে ২৫০ বছর। ভাবতে পারিস? ২৫০ বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ, যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছিল, তারাও বিশ্বাস করত যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘােরে। এই ২৫০ বছরে তাদের মধ্যে যারা যারা মারা গেছে, তারা এই বিশ্বাস নিয়েই মারা গেছে যে, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘােরে। সাজিদ সিগারেট ধরাল। ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকাল। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল-‘তাতে কী? তখন তাে আর টেলিস্কোপ ছিল না, তাই ভুল মতবাদ দিয়েছে আর কি। পরে নিকোলাস কোপারনিকাস এসে তার থিওরিকে ভুল প্রমাণ করল না?’ -হ্যাঁ। কোপারনিকাসও কিন্তু একটা মস্তবড় ভুল করে গেছে। সাজিদ প্রশ্ন করল-“কী রকম? -“অদ্ভুত! এটা তাে তাের জানার কথা। কোপারনিকাস টলেমির থিওরির বিপরীত থিওরি দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘােরে। কিন্তু তিনি এক জায়গায় ভুল করেন এবং সেই ভুলটাও বিজ্ঞান মহলে বীরদর্পে টিকে ছিল পুরাে ৫০ বছর। – ৫০ বছর? কোন্ ভুল? -“উনি বলেছিলেন, পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘােরে, কিন্তু সূর্য ঘােরে না। সূর্য স্থির। কিন্তু আজকের বিজ্ঞান বলে-নাহ, সূর্য স্থির নয়। বরং সূর্যও নিজের কক্ষপথে অবিরাম ঘুরছে। সাজিদ বলল-“সেটা ঠিক বলেছিস। কিন্তু বিজ্ঞান জগতে এটাই নিয়ম যে, বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হবে। এখানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছুই নেই। -“একদম তাই। আমিও জানি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল বলে কিছু নেই। একটা বৈজ্ঞানিক থিওরি দুই সেকেন্ডও টিকে না, আবার আরেকটা দুই শ বছরও টিকে যায়। তাই প্রমাণ বা দলিল দিয়ে যা বিশ্বাস করা হয় তাকে আমরা বিশ্বাস বলি না। এটাকে আমরা বড়জোড় চুক্তি বলতে পারি। চুক্তিটা এরকম-তােমায় ততােক্ষণ বিশ্বাস করব, যতক্ষণ তােমার চেয়ে অথেনটিক কিছু আমাদের সামনে না আসছে। সাজিদ আবার নড়েচড়ে বসল। এবার সে কিছুটা একমত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে ।প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ আমি বললাম-ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তার ধারণা বা অস্তিত্ব ঠিক এর বিপরীত। তুই দ্যাখ। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যকার এই গৃঢ় পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধর্মগ্রন্থের শুরুতেই বিশ্বাসের কথা বলা আছে। কোরআনুল কারীমের সূরা বাকারার দুই নম্বর আয়াতে বলা আছে-এটা (কোরআন) তাদের জন্য, যারা বিশ্বাস করে। যদি বিজ্ঞানে শেষ বা ফাইনাল কিছু থাকত, তাহলে হয়তাে ধর্মগ্রন্থের শুরুতে বিশ্বাসের বদলে বিজ্ঞানের কথাই বলা হতাে। হয়তাে বলা হতাে-এটা তাদের জন্যই, যারা বিজ্ঞানমনষ্ক। কিন্তু যে বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, যে বিজ্ঞানের নিজের উপর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তাকে কীভাবে অন্যরা বিশ্বাস করবে?” সাজিদ বলল-“কিন্তু যাকে দেখি না, যার পক্ষে কোনাে প্রমাণ নেই, তাকে কী করে আমরা বিশ্বাস করতে পারি? আমি বললাম-সৃষ্টিকর্তার পক্ষে অনেক প্রমাণ আছে, কিন্তু সেটা বিজ্ঞান পুরােপুরি দিতে পারে না। এটা বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, সৃষ্টিকর্তার নয়। বিজ্ঞান অনেক কিছুরই উত্তর দিতে পারে না। তালিকা করতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। আমি তালিকা ধরে বলব?’ সাজিদ রাগি রাগি গলায় বলল-ফাইজলামাে করিস আমার সাথে? আমি হাসতে হাসতে বললাম-“আচ্ছা শােন্ দোস্ত, বলছি। তাের প্রেমিকার নাম মিতু না? -“এইখানে আবার প্রেমিকার ব্যাপার আসছে কেন? -“আরে বল না দোস্ত আগে। -হ্যাঁ।-“কিছু মনে করিস না। কথার কথা বলছি। ধর, আমি মিতুকে ধর্ষণ করলাম। রক্তাক্ত অবস্থায় মিতু তার বেডে পড়ে আছে। আরও ধর, তুই কোনােভাবে ব্যাপারটা জেনে গেছিস।’ -হু। -এখন বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা কর দেখি, মিতুকে ধর্ষণ করায় কেন আমার শান্তি হওয়া দরকার? সাজিদ বলল-“ক্রিটিক্যাল কোয়েশ্চান। এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে কীভাবে ব্যাখ্যা করব? -হা হা হা। আগেই বলেছি। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার উত্তর বিজ্ঞানেনেই।-কিন্তু এর সাথে ভ্ৰষ্টায় বিশ্বাসের সম্পর্ক কী? -সম্পর্ক আছে। স্রষ্টায় বিশ্বাসটাও এমন একটা বিষয়, যেটা আমরা, মানে মানুষেরা, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণাদি দিয়ে প্রমাণ করতে পারব না। স্রষ্টা কোনাে টেলিস্কোপে ধরা পড়েন না। তাঁকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে বের করা যায় না। উনাকে স্রেফ বিশ্বাস করে নিতে হয়। সাজিদ এবার ১৮০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বেঁকে বসল । সে বলল-“ধুর! কী সব আবােল তাবােল বুঝলি। যাকে দেখি না, তাকে এভাবে বিশ্বাস করে নিব? আমি বললাম-হ্যাঁ। পৃথিবীতে অবিশ্বাসী বলে আসলে কেউই নেই। সবাই বিশ্বাসী। সবাই এমন কিছু না কিছুতে ঠিক বিশ্বাস করে, যা তারা কখনাে দেখেনি কিংবা আদৌ দেখার কোনাে সুযােগও নেই। কিন্তু এটা নিয়ে তারা প্রশ্ন তােলে। তারা নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে তাতে বিশ্বাস করে যায়। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি-তুইও ঠিক সে রকম। সাজিদ বলল-“আমি? পাগল হয়েছিস? আমি না দেখে কোনাে কিছুতেই বিশ্বাস করি না, ভবিষ্যতে কখনাে করবও না। -“ওরে দোস্ত, তুই এখনাে না দেখে অনেক কিছুই বিশ্বাস করিস এবং এটা নিয়ে ততার মধ্যে কোননাদিন কোনাে প্রশ্ন জাগেনি। আজকে এই আলােচনা না করলে হয়তাে জাগতােও না। সে আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বললাম- তুই কি জানতে চাস? -হুম।’ সাজিদ বলল। -আবার বলছি, কিছু মনে করিস না। যুক্তির খাতিরে বলছি। -“ঠিক আছে, বল। -আচ্ছা, তাের বাবা-মা’র মিলনেই যে তুই জন্মেছিস, সেটা কি তুই কখনাে দেখেছিলি? অথবা তাের কাছে এই মুহূর্তে এ সংক্রান্ত কোনাে প্রমাণ আছে? হতে পারে তাের জন্মের আগে তাের মা তাের বাবা ছাড়া অন্য কারও সাথে দৈহিক সম্পর্ক করেছে। হতে পারে তুই সেই ব্যক্তিরই জৈব ক্রিয়ার ফল। তুই এটা দেখিস নি। কিন্তু প্রমাণহীন এই বিষয় নিয়ে কোনােদিন একবারের জন্যও কি তাের মাকে প্রশ্ন করেছিলি? নিশ্চয় করিসনি। সেই ছােটবেলা থেকে যাকে বাবা হিসেবে দেখে আসছিস, এখনাে তাকে বাবা বলে ডাকছিস। যাকে ভাই হিসেবে। জেনে আসছিস, তাকে ভাই বলে ডাকিস। বােনকে বােন বলিস। তুই না দেখেই এসবে বিশ্বাস করিস না? কোনােদিন জানতে চেয়েছিস এখন যাকে বাবাপ্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ ডাকছিস, তুই আসলেই তার ঔরসজাত কি না? যাকে ভাই ভাবছিস, সে আসলেই তাের ভাই কিনা? প্রিয় বােনটি আদৌ তাের বােন কিনা? জানতে চাসনি।বিশ্বাস করে গেছিস। এখনাে করছিস। ভবিষ্যতেও করবি। স্রষ্টার অস্তিতে বিশ্বাসটাও ঠিক এমনই রে দোস্ত। এটাকে প্রশ্ন করা যায় না। সন্দেহ করা যায়।এটাকে হৃদয়ের গভীরে ধারণ করতে হয়। এর নামই বিশ্বাস। সাজিদ উঠে বাইরে চলে গেলে। ভাবলাম, সে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে। হয়তাে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বিষয়ে কথা বলে আমিও ব্ৰিত। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। পরের দিন ভােরে আমি ফজরের নামাজের জন্য অযু করতে উঠেছি। দেখলাম, আমার পাশে সাজিদ এসে দাঁড়িয়েছে। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। সে আমার চাহনির প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-“নামাজ পড়তে উঠেছি। ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি কিনা? চিমটি কেটে দেখলাম বাস্তবেই সাজিদ আমার সামনে। আমি তখন আকাশের দিকে তাকালাম। ভােরের আকাশটা তখন অনেক পরিষ্কার দেখাচ্ছি⭐ “তাকদির বনাম স্বাধীন ইচ্ছা’, স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত?সাজিদের ব্যাগে ইয়া মােটা একটি ডায়েরি থাকে সব সময়। ডায়েরিটা প্রাগৈতিহাসিক আমলের কোনাে নিদর্শনের এত। জায়গায় জায়গায় হেঁড়া। ছেড়া জায়গার কোনােটাতে সুতাে দিয়ে সেলাই করা, কোনাে জায়গায় আঁঠা দিয়ে প্রলেপ লাগানাে, কোনাে জায়গায় ট্যাপ লাগানাে। এই ডায়েরিতে সে তার জীবনের নানা উল্লেখযােগ্য ঘটনাগুলাে লিখে রাখে। বলে রাখি, সাজিদের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে আমার এক্সেস অনুমতিপ্রাপ্ত। এই ডায়েরির মাঝামাঝি কোনাে এক জায়গায় সাজিদ আমার সাথে প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও লিখে রেখেছে। তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় টিএসসিতে।। সে আমার সম্পর্কে লিখেছে‘ভ্যাবলা টাইপের এক ছেলের সাথে সাক্ষাৎ হলাে আজ। দেখলেই মনে হবে। জগতের কঠিন বিষয়ের কোনাে কিছুই সে বুঝে না। কথা বলার পরে বুঝলাম, এই ছেলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কিন্তু দেখতে হাবাগােবা। ছেলেটার নাম-আরিফ। ৫ই মার্চ, ২০০৯। এই ডায়েরিতে নানান বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও লেখা আছে। একবার কানাডার টরেন্টোতে সাজিদ তার বাবার সাথে একটি অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছিল। সেখানে অনেক সেলেব্রিটির সাথে বিল গেটসও আমন্ত্রিত ছিলেন। বিল গেটস সেখানে দশ মিনিটের জন্য বক্তৃতা রেখেছিলেন। সেই ঘটনাটিও ডায়েরিতে লেখা আছে। সিলেট শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এ্যান্ড টেকনােলজি’র কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. জাফর ইকবালের সাথে সাজিদের একবার বই মেলায় দেখা হয়ে যায়। সেবারের বইমেলায় জাফর স্যারের বই ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ এর দ্বিতীয় কিস্তি আরাে একটুখানি বিজ্ঞান প্রকাশিত হয়। বই কিনে বের। হওয়ার পথে জাফর স্যারের সাথে দেখা হয়ে যায় সাজিদের। অটোগ্রাফ নিয়ে। স্যারের কাছে হেসে জানতে চাইল স্যার, একটুখানি বিজ্ঞান পাইলাম। এরপর পাইলাম আরাে একটুখানি বিজ্ঞান। এটার পরে, আরাে আরাে একটুখানি বিজ্ঞান কবে পাচ্ছি? সেদিন নাকি জাফর স্যার মিষ্টি হেসে বলেছিলেন-“পাবে, পাবে।’ নিজের সাথে ঘটে যাওয়া এরকম অনেক ঘটনাই ঠাঁই পেয়েছে সাজিদের ডায়েরিটাতে। ডায়েরির আদ্যোপান্ত আমার পড়া ছিল। কিন্তু সেমিস্টার ফাইনাল সামনে চলে আসায় গত বেশ কিছুদিন তার ডায়েরিটা আর পড়া হয়নি।সেদিন থার্ড সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে রুমে এলাম। এসে দেখি সাক ঘরে নেই। তার টেবিলের উপরে তার ডায়েরিটা খােলা অবস্থায় পড়ে আছে। ঘর্মাক্ত শরীর। কাঠফাটা রােদের মধ্যে ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছি। ৯ মুহুর্তে বসে ডায়েরিটা উল্টাব, সে শক্তি বা ইচ্ছে কোনােটাই নেই। কিন্তু ডায়েরিটা বন্ধ করতে গিয়ে একটি শিরােনামে আমার চোখ আটকে গেল। আমি সাজিদের টেবিলেই বসে পড়ি। লেখাটির শিরােনাম ছিল-ভাগ্য বনাম স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি-স্রষ্টা কি এখানে বিতর্কিত? বেশ লােভনীয় শিরােনাম। শারীরিক ক্লান্তি ভুলেই আমি ঘটনাটির প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম। ঘটনাটি সাজিদের ডায়েরিতে যেভাবে লেখা, ঠিক সেভাবেই তুলে ধরছিকয়েকদিন আগে ক্লাসের থার্ড পিরিয়ডে মফিজুর রহমান স্যার এসে আমাকে দাঁড় করালেন। বললেন-“তুমি কি ভাগ্য, আই মিন তাকদিরে বিশ্বাস করাে?’ আমি আচমকা অবাক হলাম। আসলে এই আলাপগুলাে হলাে ধর্মীয় আলাপ । মাইক্রোবায়ােলজির একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে এসে এসব জিজ্ঞেস করেন, তখন খানিকটা ব্ৰিতবােধ করাই স্বাভাবিক। স্যার আমার উত্তরের আশায় মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আমি বললাম-“জি, স্যার। অ্যাজ এ্যা মুসলিম, আমি তাকদিরে বিশ্বাস করি। এটি আমার ঈমানের মূল ছয়টি বিষয়ের মধ্যে একটি। স্যার বললেন-“তুমি কি বিশ্বাস করাে যে, মানুষ জীবনে যা যা করবে তার সবকিছুই তার জন্মের অনেক বছর আগে তার তাকদিরে লিখে দেওয়া হয়েছে? -“জ্বি স্যার, আমি উত্তর দিলাম। -“বলা হয়, স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটি ক্ষুদ্র পাতাও নড়ে না, তাই না? -বলুন স্যার। -ধরাে, আজ সকালে আমি একজন লােককে খুন করলাম। তাহলে কি আমার তাকদিরে পূর্বনির্ধারিত ছিল না? -“জ্বি, ছিল। -“আমার তাকদির যখন লেখা হচ্ছিল, তখন কি আমি জীবিত ছিলাম? -না স্যার, জীবিত ছিলেন না। -“আমার তাকদির কে লিখেছে? কার নির্দেশে লেখা হয়েছে? -ভ্ৰষ্টার। -“তাহলে, সােজা এবং সরল লজিক এটাই বলে, আজ সকালে যে খুনটি আমি। করেছি, সেটি মূলত আমি করিনি। আমি এখানে একটি রােবট মাত্র।আমার ভেতরে একটি প্রােগ্রাম সেট করে দিয়েছেন স্রষ্টা। সেই প্রােগ্রামে লেখা ছিল যে, আজ সকালে আমি একজন লােককে খুন করব। সুতরাং আমি ঠিক তাই-ই করেছি, যা আমার জন্য স্রষ্টা পূর্বে ঠিক করে রেখেছেন। এতে আমার কোনাে হাত নেই। ডু ইউ অ্যাগ্রি, সাজিদ? -“কিছুটা স্যার, আমি উত্তর দিলাম। মফিজুর স্যার এবার হাসলেন। হেসে বললেন-“আমি জানতাম তুমি কিছুটাই একমত হবে, পুরােটা নয়। এখন তুমি আমাকে নিশ্চয়ই যুক্তি দেখিয়ে বলবে স্যার, স্রষ্টা আমাদের একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। আমরা এটা দিয়ে ভালাে-মন্দ বিচার করে চলি, রাইট? -“জ্বি স্যার। -“কিন্তু সাজিদ, এটা খুবই লেইম লজিক। ডু ইউ নাে? ধরাে, আমি তােমার হাতে বাজারের একটি তালিকা দিলাম। তালিকায় যা যা কিনতে হবে, তার সবকিছু লেখা আছে। এখন তুমি বাজার করে ফিরলে। তুমি ঠিক তাই তাই কিনলে যা আমি তালিকায় লিখে দিয়েছি এবং তুমি এটা করতে বাধ্য। এতটুকু বলে স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন-বুঝতে পারছ? আমি বললাম-“জ্বি স্যার। -“ভেরি গুড! ধরাে, তুমি বাজার করে আসার পর, একজন জিজ্ঞেস করল, সাজিদ কী কী বাজার করেছ? তখন আমি উত্তর দিলাম, ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, তা-ই কিনেছে। বলাে তাে, আমি সত্য বলেছি কিনা? আমি বললাম-“নাহ, আপনি মিথ্যা বলেছেন। স্যার চিল্কার করে বলে উঠলেন-এক্সাক্টলি । ইউ হ্যাভ গট দ্য পয়েন্ট মাই ডিয়ার। আমি মিথ্যা বলেছি। আমি তালিকাতেই বলে দিয়েছি তােমাকে কী কী কিনতে হবে। তুমি ঠিক তা-ই কিনেছ, যা আমি কিনতে বলেছি। যা কিনেছ সব আমার পছন্দের জিনিস। এখন আমি যদি বলি- ‘ওর যা যা খেতে মন চেয়েছে, | সে তাই তাই কিনেছে’, তাহলে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা হবে, তাই না? -“জ্বি, স্যার। -ঠিক স্রষ্টাও এভাবে মিথ্যা বলেছেন। দুই নাম্বারি করেছেন। তিনি অনেক আগে আমাদের তাকদির লিখে তা আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এখন আমরা সেটাই করি, যা স্রষ্টা সেখানে লিখে রেখেছেন। এ্যান্ড অ্যাট দ্যা এন্ড অফ দ্য ডে, এই কাজের জন্য কেউ জান্নাতে যাচ্ছে, কেউ জাহান্নামে। কিন্তু কেন? এখানে মানুষের তাে কোনাে হাত নেই। ম্যানুয়ালটা স্রষ্টার তৈরি। আমরা তাে জাস্ট পারফর্মার। স্ক্রিপ্ট রাইটার তাে স্রষ্টা। স্রষ্টা এর জন্য আমাদের কাউকে জান্নাত, কাউকে জাহান্নাম দিতে পারেন না। যুক্তি তাই বলে, ঠিক? আমি চুপ করে রইলাম। পুরাে ক্লাসে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে তখন। স্যার বললেন-“হ্যাভ ইউ অ্যানি প্রােপার লজিক অন দ্যাট টিপিক্যাল কোয়েশ্চান, ডিয়ার? আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। স্যার মুচকি হাসলেন। সম্ভবত ভাবছেন, উনি আমাকে এবার সত্যি সত্যিই কুপােকাত করে দিলেন। বিজয়ীর হাসি। আমাকে যারা চিনে তারা সবাই জানে, আমি কখনাে কারও প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নিই না। আজকে যেহেতু তার ব্যতিক্রম ঘটল, বন্ধুরা আমার দিকে ড্যাব। ড্যাব চোখ করে তাকাল। তাদের চাহনি দেখে মনে হচ্ছিল, এই সাজিদর্কে তারা চেনেই না। কোনােদিন দেখেনি। ক্লাসে আমার বিরুদ্ধমতের যারা আছে, তাদের চেহারা তখন মূহুর্তেই উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করল। তারা হয়তাে মনে মনে ভাবতে লাগল- ‘মােল্লাজির দৌঁড় ঐ মসজিদ পর্যন্তই। আমি মুখ তুলে স্যারের দিকে তাকালাম। মুচকি হাসিটা স্যারের মুখে তখনও বিরাজমান। আমি বললাম-স্যার, এই ক্লাসে কার সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? স্যার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। স্যার জিজ্ঞেস করেছেন কী আর আমি বলছি কী। স্যার বললেন-বুঝলাম না। -মানে, আমাদের ক্লাসের কার মেধা কী রকম, সে বিষয়ে আপনার ধারণা কেমন? -ভালাে ধারণা। ছাত্রদের সম্পর্কে একজন শিক্ষকেরই তাে সবচেয়ে ভালাে জ্ঞান থাকে। আমি বললাম-“স্যার, আপনি বলুন তাে, এই ক্লাসের কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে। আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে? স্যার কিছুটা বিস্মিত হলেন। বললেন-“আমি তােমাকে অন্য বিষয়ে প্রশ্ন করেছি। তুমি আউট অফ কনটেক্সটে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করছ, সাজিদ। -না স্যার, আমি কনটেক্সটেই আছি। আপনি উত্তর দিন। স্যার বললেন-“এই ক্লাস থেকে রায়হান, মমতাজ, ফারহানা, সজীব, ওয়ারেস, . ইফতি, সুমন, জাবেদ ও তুমি ফার্স্ট ক্লাস পাবে। আর বাকিরা সেকেন্ড ক্লাস পাবে।স্যার যাদের নাম বলেছেন, তারা সবাই ক্লাসের ব্রিলিয়্যান্ট স্টুডেন্ট। সুতরাং স্যারের অনুমান খুব একটা ভুল না। আমি বললাম-স্যার, আপনি এটা লিখে দিতে পারেন? – ‘হােয়াই নট, স্যার বললেন। এই বলে তিনি খচখচ করে একটা কাগজের একপাশে যারা ফাস্ট ক্লাস পাবে তাদের নাম, অন্যপাশে যারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিলেন। আমি বললাম-স্যার, ধরে নিলাম যে, আপনার ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ সত্য হয়েছে। মানে, আপনি ফার্স্ট ক্লাস পাবেন বলে যাদের নাম লিখেছেন, তারা সবাই ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে, আর যারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে লিখেছেন, তাদের সবাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। -হুম, তাে? -“এখন, স্যার বলুন তাে প্লিজ, যারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, কেবলমাত্র আপনি এই কাগজে তাদের নাম লিখেছেন বলেই কি তারা ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে? -নাহ তাে। -“যারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে, কেবলমাত্র আপনি এই কাগজে লিখেছেন বলেই কি তারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে? স্যার বললেন-‘একদম না। -তাহলে মূল ব্যাপারটি কী স্যার? স্যার বললেন-মূল ব্যাপার হলাে, আমি তােমাদের শিক্ষক। আমি খুব ভালাে জানি পড়াশােনায় তােমাদের কে কেমন। আমি খুব ভালাে করেই জানি, কার মেধা কেমন। সুতরাং আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কে কেমন রেজাল্ট করবে। আমি হাসলাম। বললাম-“স্যার, যারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে, তারা যদি আপনাকে দোষ দেয়? যদি বলে, আপনি সেকেন্ড ক্লাস’ ক্যাটাগরিতে তাদের নাম লিখেছেন বলেই তারা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে? স্যার কপালের ভাঁজ লম্বা করে বললেন-“ইট উড বি টোট্যালি রং! আমি কেন এর জন্য দায়ী হবাে? এটা তাে সম্পূর্ণ তাদের দায়। আমি শুধু তাদের মেধা, যােগ্যতা সম্পর্কে ধারণা রাখি বলেই অগ্রীম বলে দিতে পেরেছি যে, কে কেমন রেজাল্ট করবে।আমি এবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। পুরাে ক্লাস আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি থামলাম। বললাম-“স্যার, তাকদির তথা ভাগ্যটাও ঠিক এ রকম। আপনি যেমন আমাদের মেধা, যােগ্যতা, ক্ষমতা সম্পর্কে ভালাে ধারণা রাখেন, সম্ভার তেমনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে জানেন। আপনার ধারণা মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে। কিন্তু স্রষ্টার জানাতে কোনাে ভুল নেই। স্রষ্টা হলেন আলিমুল গায়েব। তিনি ভতবর্তমান-ভবিষ্যৎ সব জানেন। সব। ‘আপনি আমাদের সম্পর্কে পূর্বানুমান করে লিখে দিয়েছেন যে, আমাদের মধ্যে। কারা কারা ফার্স্ট ক্লাস পাবে, আর কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনি বলেছেন বলে আমরা কেউ ফাস্ট ক্লাস পাচ্ছি, কেউ সেকেন্ড ক্লাস। পাচ্ছি। আমরা যে যা রেজাল্ট করছি, সেটা তার মেধা, যােগ্যতা ও পরিশ্রমের আল্টিমেট ফল। ‘তাে স্রষ্টা যেহেতু তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে সব জানেন, কাজেই তিনি সে অনুযায়ী আমাদের তাকদির লিখে রেখেছেন। তাতে লেখা আছে দুনিয়ায় আমরা কে কী করব। এর মানেও কিন্তু এই নয় যে, তিনি লিখে দিয়েছেন বলেই আমরা কাজগুলাে করছি। বরং এর মানে হলাে এই তিনি জানেন যে, আমরা দুনিয়ায় এই এই কাজগুলাে করব। তাই তিনি তা অগ্রীম লিখে রেখেছেন তাকদির হিসেবে। ‘আমাদের মধ্যে কেউ ফাস্ট ক্লাস আর কেউ সেকেন্ড ক্লাস পাবার জন্য যেমন কোনােভাবেই আপনি দায়ী নন; ঠিক সেভাবে মানুষের মধ্যে কেউ ভালাে কাজ করে জান্নাতে, আর কেউ খারাপ কাজ করে জাহান্নামে যাবার জন্যও স্রষ্টা দায়ী নন। স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ সকালে একজনকে খুন করবেন। তাই তিনি সেটা আগেই আপনার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। এটার মানে এই নয় যে স্রষ্টা লিখে রেখেছেন বলেই আপনি খুনটি করেছেন। এর মানে হলাে-স্রষ্টা জানেন যে, আপনি আজ খুনটি করবেন। তাই সেটা অগ্রিম লিখে রেখেছেন আপনার তাকদির। হিসেবে। স্যার, ব্যাপারটা কি এখন পরিষ্কার?’। স্যারের চেহারা কিছুটা ফ্যাকাসে মনে হলাে। তিনি বললেন-“হুম। এরপর স্যার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন-“আমি শুনেছিলাম তুম। কদিন আগেও নাস্তিক ছিলে। তুমি আবার আস্তিক হলে কবে? আমি হা হা হা করে হাসলাম। বললাম স্যার এই প্রশ্নটা কিন্তু আউট অফ কনটেক্সট।এটা শুনে পুরাে ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ল। স্যার এবার ক্লাসের একাডেমিক লেকচার শুরু করলেন। ক্লাসের একদম শেষদিকে স্যার আবার আমাকে দাঁড় করালেন। বললেন-বুঝলাম স্রষ্টা আগে থেকে জানেন বলেই লিখে রেখেছেন। তিনি যেহেতু আগে থেকেই জানেন, কে ভালাে কাজ করবে আর কে খারাপ কাজ করবে, তাহলে পরীক্ষা নেওয়ার কি দরকার? যারা জান্নাতে যাওয়ার তাদের জান্নাতে, আর যারা জাহান্নামে যাওয়ার তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তাে হতাে, তাই না? আমি আবার হাসলাম। আমার হাতে স্যারের লিখে দেওয়া কাগজটি তখনও ধরা ছিল। আমি সেটা স্যারকে দেখিয়ে বললাম-“স্যার, এই কাগজে কারা কারা ফাস্ট ক্লাস পাবে, আর কারা কারা সেকেন্ড ক্লাস পাবে, তাদের নাম লেখা আছে। তাহলে এই কাগজটির ভিত্তিতেই রেজাল্ট দিয়ে দিন। বাড়তি করে পরীক্ষা নিচ্ছেন কেন? স্যার বললেন-‘পরীক্ষা না নিলে কেউ হয়তাে এই বলে অভিযােগ করতে পারে যে, স্যার আমাকে ইচ্ছা করেই সেকেন্ড ক্লাস দিয়েছে। পরীক্ষা দিলে আমি হয়তাে ঠিকই ফার্স্ট ক্লাস পেতাম। আমি বললাম-‘একদম তাই, স্যার। স্রষ্টাও এজন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন, যাতে কেউ বলতে না পারে: দুনিয়ায় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমি অবশ্যই আজকে জান্নাতে থাকতাম। স্রষ্টা ইচ্ছা করেই আমাকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন। ক্লাসের সবাই হাততালি দিতে শুরু করল। স্যার বললেন-“সাজিদ, আই হ্যাভ অ্যা লাস্ট কোয়েশ্চান।’ -ডেফিনেইটলি, স্যার, আমি বললাম। -“আচ্ছা, যে মানুষ পুরাে জীবনে খারাপ কাজ বেশি করে, সে অন্তত কিছু না কিছু ভালাে কাজ তাে করে, তাই না? -“জ্বি স্যার। -তাহলে, এই ভালাে কাজগুলাের জন্য হলেও তাে তার জান্নাতে যাওয়া দরকার, তাই না? আমি বললাম- স্যার, পানি কীভাবে তৈরি হয়? স্যার আবার অবাক হলেন। হয়তাে বলতে যাচ্ছিলেন যে, এই প্রশ্নটাও আউট অফ কনটেক্সট। কিন্তু কী ভেবে যেন চুপসে গেলেন। বললেন-“দুই ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে। আমি বললাম-“আপনি এক ভাগ হাইড্রোজেন আর এক ভাগ অক্সিজেন দিয়ে পানি তৈরি করতে পারবেন?-কখনােই না।’ -ঠিক সেভাবে, এক ভাগ ভালাে কাজ আর এক ভাগ মন্দ কাজে জান্নাত পাওয়া যায় না। জান্নাত পেতে হলে হয় তিন ভাগই ভালাে কাজ হতে হবে, নতুবা দই ভাগ ভালাে কাজ, এক ভাগ মন্দ কাজ হতে হবে। অর্থাৎ, ভালাে কাজের পালা। ভারী হওয়া আবশ্যক। সেদিন স্যার আর কোনাে প্রশ্ন আমাকে করেননি। ডায়েরিতে সাজিদের লেখা এক নিশ্বাসে পুরােটা পড়ে ফেললাম। কোথাও একটুও থামিনি। পড়া শেষে যেই মাত্র ডায়েরিটা বন্ধ করতে যাবাে, অমনি দেখলাম, পেছন থেকে সাজিদ এসে আমার কান মলে ধরেছে। বলল-“তুই তাে সাংঘাতিক লেভেলের চোর। চুরি করে আমার ডায়রি পড়ছিস। আমি হেসে বললাম-“হা হা হা। ভুলে গেছিস যে, এই ডায়রি পড়ার এক্সেস তুই নিজেই আমাকে দিয়েছিলি! সাজিদ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল-সেটা আমার উপস্থিতিতে কিন্তু! আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে বললাম, ‘স্যারকে তাে সেদিন ভালাে জব্দ করেছিস রে । দোস্ত!’ কথাটা সে কানে নিল বলে মনে হলাে না। নিজের সম্পর্কে কোনাে কমপ্লিমেন্টই সে আমলে নেয় না। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে খাটের উপর শুয়ে পড়ল। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম। বললাম-“সাজিদ…’। -হু’ -একটা কথা বলব? -বল।’-“জানিস, এক সময় যুবকেরা হিমু হতে চাইতাে। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, মরুভূমিতে গর্ত খুঁড়ে জ্যোত্স দেখার স্বপ্ন দেখতাে। দেখিস, এমন একদিন আসবে, যেদিন যুবকেরা সাজিদ হতে চাইবে। ঠিক তাের মতাে। কথাগুলাে বলেই আমি সাজিদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে। পড়েছে। অঘাের ঘুম…। এক প্রশান্ত মুখের দিক থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না।⭐ স্রষ্টা কেন মন্দ কাজের দায় নেন না?মফিজুর রহমান স্যারের ক্লাস। স্যার হালকা-পাতলা গড়নের। বাতাস এলেই যেন ঢলে পড়বেন। খুবই খারাপ অবস্থা শরীরের। ভদ্রলােকের চেহারার চেয়ে চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকম বড়। দেখলেই মনে হয় যেন বড় বড় সাইজের দুটি জলপাই কেউ খােদাই করে বসিয়ে দিয়েছে। তবে ভদ্রলােক খুবই ভালাে মানুষ। উনার সমস্যা একটিই-ক্লাসে উনি যতটা না বায়ােলজি পড়ান, তার চেয়ে বেশি দর্শন চর্চা করেন। ধর্ম কোথা থেকে এল, ঠিক কবে থেকে মানুষ ধার্মিক হওয়া শুরু করল, ‘ধর্ম আদতে কী আর, কী নয়’ এসবই তার আগ্রহ ও আলােচনার কেন্দ্রবিন্দু। আজকে উনার চতুর্থ ক্লাশ। পড়াবেন Analytical Techniques & BioInformatics। চতুর্থ সেমিস্টারে এটা পড়ানাে হয়। স্যার এসে প্রথমে বললেন-‘Good Morning, Guys.’ সবাই সমস্বরে বলল-‘Good Morning, Sir.’ এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন-সবাই কেমন আছাে? স্যারের আরও একটি ভালাে দিক হলাে উনি ক্লাসে এলে এভাবেই সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। সাধারণত হায়ার লেভেলে যেটা সব শিক্ষক করেন না। তারা রােবটের মত ক্লাসে আসেন, যন্ত্রের মত করে লেকচার পড়িয়ে বেরিয়ে যান। সেদিক থেকে মফিজুর রহমান নামের এই ভদ্রলােক অনেকটা অন্যরকম। আবারও সবাই সমস্বরে উত্তর দিল। কিন্তু গােলমাল বাঁধল এক জায়গায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন উত্তর দিয়েছে এভাবে-“আলহামদুলিল্লাহ ভালাে। স্যার কপালের ভাঁজ একটু দীর্ঘ করে বললেন-“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালাে বলেছাে কে কে? অদ্ভুত প্রশ্ন। সবাই থতমত খেলাে। একটু আগেই বলেছি স্যার একটু অন্যরকম। প্রাইমারি লেভেলের টিচারদের মত ক্লাসে এসে বিকট চিৎকার করে Good Morning বলেন, সবাই কেমন আছে জানতে চান। এখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার জন্য কি প্রাইমারি লেভেলের শিক্ষকদের মত বেত দিয়ে পিটাবেন না কি?সাজিদের তখন তার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বাবুল চন্দ্র দাশের কথা মনে পড়ে গেল। এই লােকটা ক্লাসে কেউ দুটোর বেশি হাঁচি দিলেই বেত দিয়ে আচ্ছা মতাে পেটাতেন। উনার কথা হলাে-হাঁচির সর্বোচ্চ পরিমাণ হবে দুটি। দুটির বেশি হাঁচি দেওয়া মানে ইচ্ছে করেই বেয়াদবি করা। যা হােক, বাবুল চন্দ্রের পাঠ তাে কবেই চুকেছে, এবার মফিজ স্যারের হাতেই না গণপিটুনি খাওয়া লাগে। ক্লাসের সর্বমােট সাতজন দাঁড়াল। এরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালাে বলেছে। এরা হচ্ছে-রাকিব, আদনান, জুনায়েদ, সাকিব, মরিয়ম, রিতা ও সাজিদ। স্যার সবার চেহারাটা একটু ভালাে মত পরখ করে নিলেন। এরপর ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন-বসাে।’ সবাই বসল। আজকে আর মনে হয় একাডেমিক পড়াশােনা হবে না। দর্শনের তাত্ত্বিক আলাপ হবে। ঠিক তাই হলাে। মফিজুর রহমান স্যার আদনানকে দাঁড় করালেন। বললেন-“তুমিও বলেছিলে সেটা, না? -“জ্বি স্যার।’, আদনান উত্তর দিল। স্যার বললেন-“আলহামদুলিল্লাহর অর্থ কি জানাে? আদনান মনে হয় একটু ভয় পাচ্ছে। সে ঢোঁক গিলতে গিলতে বলল-“জ্বি স্যার, আলহামদুলিল্লাহ্ অর্থ হলাে: সকল প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর। স্যারও বললেন-“সকল প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহর। স্যার এই বাক্যটি দুবার উচ্চারণ করলেন। এরপর আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন-বসাে। আদনান বসল। এবার স্যার রিতাকে দাঁড় করালেন। স্যার রিতার কাছে জিজ্ঞেস করলেন-“আচ্ছা, পৃথিবীতে চুরি-ডাকাতি আছে? রিতা বলল-“আছে।’ -“খুন-খারাবি, রাহাজানি, ধর্ষণ? -“জ্বি,আছে। -কথা দিয়ে কথা না রাখা, মানুষকে ঠকানাে, লােভ-লালসা এসব? -“জ্বি, আছে। -“এগুলাে কি প্রশংসাযযাগ্য? -না।’তাহলে মানুষ একটি ভালাে কাজ করার পর তার সব প্রশংসা যদি আল্লাহ্র হয়, মানুষ যখন চুরি-ডাকাতি করে, লােক ঠকায়, খুন-খারাবি করে, ধর্ষণ করে, তখন সব মন্দের ক্রেডিট আল্লাহকে দেওয়া হয় না কেন? উনি প্রশংসার ভাগ পাবেন, কিন্তু দুর্নামের ভাগ নিবেন না-তা কেমন একপেশে হয়ে গেল না? রিতা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। স্যার বললেন-“এখানেই ধর্মের ভেল্কিবাজি। ঈশ্বর শুধু ভালােটা বােঝেন, কিন্তু মন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আদতে, ঈশ্বর বলে কেউ নেই। যদি থাকত, তাহলে তিনি এরকম একচোখা হতেন না। বান্দার ভালাে কাজের ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিবেন, কিন্তু মন্দ কাজের বেলায় বলবেন-উহু, ঐটা থেকে আমি পবিত্র। ঐটা তােমার ভাগ। স্যারের কথা শুনে ক্লাসে যে কজন নাস্তিক আছে, তারা হাততালি দেওয়া শুরু করল। সাজিদের পাশে যে নাস্তিকটা বসেছে, সে তাে বলেই বসল-মফিজ স্যার হলেন আমাদের বাংলার প্লেটো। স্যার ধর্ম আর স্রষ্টার অসাড়তা নিয়ে বলেই যাচ্ছেন। এবার সাজিদ দাঁড়াল। স্যারের কথার মাঝে সে বলল-“স্যার, সৃষ্টিকর্তা একচোখা নন। তিনি মানুষের ভালাে কাজের ক্রেডিট নেন না। তিনি ততােটুকুই নেন, যতটুকু তিনি পাবেন। ঈশ্বর আছেন। স্যার সাজিদের দিকে একটু ভালােভাবে তাকালেন। বললেন-“শিওর? -“জ্বি। -তাহলে মানুষের মন্দ কাজের জন্য কে দায়ী? -মানুষই দায়ী।’, সাজিদ বলল। -ভালাে কাজের জন্য? -তা-ও মানুষ। স্যার এবার চিৎকার করে বললেন-‘এক্সাক্টলি, এটাই বলতে চাচ্ছি। ভালাে-মন্দ এসব মানুষেরই কাজ। সুতরাং এর সব ক্রেডিটই মানুষের। এখানে স্রষ্টার কোনাে হাত নেই। তিনি এখান থেকে না প্রশংসা পেতে পারেন, না তিরস্কার। সােজা কথায়, স্রষ্টা বলতে কেউই নেই। ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। সাজিদ বলল-মানুষের ভালাে কাজের জন্য স্রষ্টা অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। কারণ মানুষকে স্রষ্টা ভালাে কাজ করার জন্য দুটি হাত দিয়েছেন, ভালাে জিনিস দেখার জন্য দুটি চোখ দিয়েছেন, চিন্তা করার জন্য মস্তিষ্ক দিয়েছেন, দুটি পা দিয়েছেন। এসবকিছুই স্রষ্টার দান। তাই ভালাে কাজের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাবেন।স্যার বললেন-“এগুলাে দিয়ে তাে মানুষ খারাপ কাজও করে, তখন? -এর দায় স্রষ্টার নয়। -হা হা হা। তুমি খুব মজার মানুষ দেখছি। একই সাথে কিছুটা বােকাও বটে! হা। হা হা। সাজিদ বলল-“স্যার, স্রষ্টা মানুষকে একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। এটা দিয়ে সে নিজেই নিজের কাজ ঠিক করে নেয়। সে কি ভালাে করবে, নাকি মন্দ করবে। স্যার তিরস্কারের সুরে বললেন-ধর্মীয় কিতাবাদির কথা বাদ দাও। কাম টু দ্যা পয়েন্ট অ্যান্ড বি লজিক্যাল। সাজিদ বলল-“স্যার, আমি কি উদাহরণ দিয়ে বােঝাতে পারি বিষয়টা?” -অবশ্যই।’, স্যার বললেন। সাজিদ বলতে শুরু করল‘ধরুন, খুব গভীর সাগরে একটি জাহাজ ডুবে গেল। ধরুন, সেটা বার্মুড়া ট্রায়াঙ্গাল। কোনাে ডুবুরিই সেখানে ডুব দিয়ে জাহাজের মানুষগুলােকে উদ্ধার করতে পারছে না। বার্মুডা ট্রায়াঙ্গালে তাে নয়ই। এই মুহুর্তে ধরুন সেখানে আপনার আবির্ভাব ঘটল । আপনি সবাইকে বললেন-“আমি এমন একটি যন্ত্র বানিয়ে দিতে পারি, যেটা গায়ে লাগিয়ে যেকোনাে মানুষ খুব সহজেই ডুবে যাওয়া জাহাজের মানুষগুলােকে উদ্ধার করতে পারবে। ডুবুরির কোনাে রকম ক্ষতি হবে না।’ স্যার বললেন-“হুম, তাে? -‘ধরুন, আপনি যন্ত্রটি তৎক্ষণাৎ বানালেন এবং একজন ডুবুরি সেই যন্ত্র গায়ে লাগিয়ে ডুবে যাওয়া মানুষগুলােকে উদ্ধার করতে সাগরে নেমে পড়ল। ক্লাসে তখন একদম পিনপতন নীরবতা। সবাই মুগ্ধ শ্রোতা। কারও চোখের পলকই যেন পড়ছে না। সাজিদ বলে যেতে লাগল-ধরুন, ডুবুরিটা ডুব দিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সে দেখল, মানুষগুলাে হাঁসফাঁশ করছে। সে একে একে সবাইকে একটি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে দিল। তাদেরকে একজন একজন করে উদ্ধার করতে লাগল। স্যার বললেন-“হুম। সাজিদ বলছে-‘ধরুন, সব যাত্রীকে উদ্ধার করা শেষ। বাকি আছে মাত্র একজন। ডুবুরি যখন শেষ লােকটাকে উদ্ধার করতে গেল, তখন দেখল, এই লােকটাকে সে আগে থেকেই চিনে।এতটুকু বলে সাজিদ স্যারের কাছে প্রশ্ন করল-স্যার, এরকম কি হতে পারে না? স্যার বললেন-“অবশ্যই হতে পারে। লােকটা ডুবুরির আত্মীয় বা পরিচিত হয়ে যেতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাজিদ বলল–জ্বি। ডুবুরি লােকটাকে চিনতে পারল। সে দেখল, এটা হচ্ছে তার চরম শত্রু। এই লােকের সাথে তার দীর্ঘদিনের বিরােধ চলছে। এরকম হতে পারে না, স্যার? -“হ্যাঁ, হতে পারে। সাজিদ বলল-“ধরুন, ডুবুরির মধ্যে ব্যক্তিগত হিংসাবােধ জেগে উঠল। সে শত্রুতাবশত ঠিক করল যে, এই লােকটাকে সে বাঁচাবে না। কারণ লােকটা তার দীর্ঘদিনের শত্রু। সে এই চরম সুযােগে প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে উঠল। ধরুন, ডুবুরি ঐ লােকটাকে অক্সিজেনের সিলিন্ডার তাে দিলই না, উল্টো উঠে আসার সময় লােকটার পেটে একটা জোরে লাথি দিয়ে এল। ক্লাসে তখনও পিনপতন নীরবতা। সবাই সাজিদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্যার বললেন-“তাে, তাতে কি প্রমাণ হয়, সাজিদ? সাজিদ স্যারের দিকে ফিরল। ফিরে বলল-‘Let me finish my beloved sir’। -‘Okey, you are permitted. Carry on.’, স্যার বললেন। সাজিদ এবার প্রশ্ন করল-“স্যার, বলুন তাে, এই যে, এতগুলাে ডুবে যাওয়া মানুষগুলােকে ডুবুরি উদ্ধার করে আনল, এর জন্য আপনি নিজে কি কোনাে ক্রেডিট পাবেন? স্যার বললেন-“অবশ্যই আমি ক্রেডিট পাবাে। কারণ, আমি যদি ঐ বিশেষ যন্ত্রটিবানিয়ে দিতাম, তাহলে তাে এই লােকগুলাের কেউই বাঁচত না। সাজিদ বলল-“একদম ঠিক স্যার। আপনি অবশ্যই এর জন্য ক্রেডিট পাবেন। কিন্তু পরবর্তী ব্যাপার হচ্ছে, ‘ডুবুরি সবাইকে উদ্ধার করলেও, একজন লােককে সে শত্রুতাবশত উদ্ধার না করে মৃত্যুকূপে ফেলে রেখে এসেছে। আসার সময় তার পেটে একটি জোরে লাথিও দিয়ে এসেছে। ঠিক? -হুম। -“এখন স্যার, ডুবুরির এমন অন্যায়ের জন্য কি আপনি দায়ী হবেন? ডুবুরির এই অন্যায়ের ভাগটা কি সমানভাবে আপনিও ভাগ করে নেবেন?স্যার বললেন-“অবশ্যই না। ওর দোষের ভাগ আমি কেন নিব? আমি তাে তাকে এরকম অন্যায় কাজ করতে বলিনি। সেটা সে নিজে করেছে। সুতরাং এর পুরাে দায় তাকেই বহন করতে হবে।’ সাজিদ এবার হাসল। হেসে সে বলল-“স্যার, ঠিক একইভাবে, আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আপনি যেরকম ডুবুরিকে একটা বিশেষ যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছেন, সেরকম সৃষ্টিকর্তাও মানুষকে অনুগ্রহ করে হাত, পা, চোখ, নাক, কান, মুখ, মস্তিষ্ক এসব দিয়ে দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি। এখন এসব ব্যবহার করে সে যদি কোনাে ভালাে কাজ করে, তবে তার ক্রেডিট স্রষ্টাও পাবেন। ঠিক যে রকম বিশেষ যন্ত্রটি বানিয়ে আপনি ক্রেডিট পাচ্ছেন। আবার সে মানুষ যদি এগুলাে ব্যবহার করে কোনাে খারাপ কাজ করে, গর্হিত কাজ করে, তাহলে এর দায়ভার স্রষ্টা নেবেন না। যে রকম ডুবুরির ঐ অন্যায়ের দায় আপনার উপর বর্তায় না। আমি কি বুঝাতে পেরেছি, স্যার? ক্লাসে এতক্ষণ ধরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল। এবার ক্লাসের সকল আস্তিকেরা মিলে একসাথে জোরে জোরে হাততালি দেওয়া শুরু করল। স্যারের জবাবের আশায় সাজিদ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার বললেন-“হুম। আই গট দ্যা পয়েন্ট।’, এই বলে স্যার সেদিনের এত ক্লাস শেষ করে চলে যান।⭕ শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্বখুব সকালবেলা। সাজিদের কাছে একটি মেইল এসেছে। মেইলটি পাঠিয়েছে তার নাস্তিক বন্ধু বিপ্লব ধর। বিপ্লবদাকে আমিও চিনি। সদাহাস্য এই লােকটার সাথে মাঝে মাঝেই টিএসসিতে দেখা হতাে। দেখা হলেই উনি একটি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন-তুই কি এখনাে রাতের বেলা ভূত দেখিস? বিপ্লবদা মনে হয় হাসিটি প্রস্তুত করেই রাখত। দেখা হওয়া মাত্রই ডেলিভারি দিত। বিপ্লবদাকে চিনতাম সাজিদের মাধ্যমে। সাজিদ আর বিপ্লবদা একই ডিপার্টমেন্টের। বিপ্লবদা সাজিদের চেয়ে দুই ব্যাচ সিনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে সাজিদ যে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিল, তার পেছনের কারিগর বিপ্লবদা। বিপ্লবদা তাকে বিভিন্ন নাস্তিক, অ্যাগনােস্টিকদের বই পড়িয়ে নাস্তিক বানিয়ে ফেলেছিল। সময়ের ব্যবধানে সাজিদ এখন আর নাস্তিক নেই। ইতােমধ্যে বিশ্বাসের দেয়ালে প্রথম চুমােটি দিয়ে ফেলেছে। আমি ক্লাস শেষে রুমে ঢুকে দেখলাম সাজিদ বরাবরের মতই কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। কী যেন লিখছে। আমাকে দেখামাত্রই বলল-“তাের দাওয়াত আছে। -কোথায়?”, আমি জিজ্ঞেস করলাম। সাজিদ বলল-বিপ্লবদা দেখা করতে বলেছেন। আমার সাথে উনার কোনাে লেনদেন নেই। আমাকে এভাবে দেখা করতে বলার হেতু কি বুঝলাম না। সাজিদ বলল-ঘাবড়ে গেলি নাকি? তােকে একা না, সাথে আমাকেও। এই বলে সাজিদ বিপ্লবদার মেইলটি ওপেন করে দেখাল। মেইলটি হুবহু এরকমসাজিদ,আমি তােমাকে একজন প্রগতিশীল, উদারমনসম্পন্ন, মুক্তমনা ভাবতাম। পড়াশােনা করে তুমি কথিত ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসেছিলে। কিন্তু তুমি যে আবার সেই অন্ধ বিশ্বাসের জগতে ফিরে যাবে-সেটা কল্পনাও করিনি আমি। আজ বিকেলে বাসায় এসাে। তােমার সাথে আলাপ আছে।আমরা খাওয়া-দাওয়া করে, যােহরের নামাজ পড়ে বিপ্লবদার সাথে দেখা করার জন্য বের হলাম। বিপ্লবদা আগে থাকতেন বনানী, এখন থাকেন কাঁটাবনে। জ্যাম কাটিয়ে আমরা যখন বিপ্লবদার বাসায় পৌছলাম, তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে। গেছে। বিপ্লবদার সাথে হ্যান্ডশেক করে আমরা বসলাম না। সাজিদ বলল-“দাদা, আলাপ একটু পরে হবে। আগে আসরের নামাজটা পড়ে আসি।’ বিপ্লবদা না করলেন না। আমরা বেরিয়ে গেলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে আসরের নামাজ পড়ে ব্যাক করলাম। বিপ্লবদা ইতােমধ্যেই কফি তৈরি করে রেখেছেন। খুবই উন্নতমানের কফি। কফির গন্ধটা পুরাে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই। সাজিদ কফি হাতে নিতে নিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল-“জানিস, বিপ্লবদার এই কফি বিশ্ববিখ্যাত। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি। বিপ্লবদা কানাডা থেকে অর্ডার করিয়ে আনেন। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মনে হলাে আসলেই সত্যি। এত ভালাে কফি হতে পারে-ভাবাই যায় না। সাজিদ এবার বিপ্লবদার দিকে তাকিয়ে বলল-“আলাপ শুরু হােক।’ বিপ্লবদার মুখে সদাহাস্য ভাবটা আজকে নেই। উনার পরম শিষ্যের এরকম অধঃপতনে সম্ভবত মন কিছুটা বিষন্ন। বললেন-তােমার সিদ্ধান্তের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তবে তােমাকে একটি বিষয়ে বলার জন্যই আসতে বলেছি। হয়তাে তুমি ব্যাপারটি জেনে থাকবে, তবুও। সাজিদ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল- ‘জানা বিষয়টাও আপনার মুখ থেকে শুনলে মনে হয় নতুন জানছি। আমি আপনাকে কতটা পছন্দ করি, তা তাে আপনি জানেনই।’ বিপ্লবদা কোনাে ভূমিকায় গেলেন না। সরাসরি বললেন-“ঐ যে, তােমার সৃষ্টিকর্তা, উনার ব্যাপারে বলতে চাই। তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি হয়তাে এ ব্যাপারে জানাে। সম্প্রতি বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোনাে ভূমিকা নেই। মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকেই। আগে তােমরা, মানে বিশ্বাসীরা বলতে, একটা সামান্য উঁচও যখন কোনাে কারিগর ছাড়া এমনি এমনি তৈরি হতে পারে না, তাহলে এই গােটা মহাবিশ্ব কীভাবে তৈরি হবে আপনাআপনি? কিন্তু বিজ্ঞান এখন বলছে, এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে আপনা-আপনিই : তৈরি হয়েছে। কারও সাহায্য ছাড়াই।এই কথাগুলাে বিপ্লবদা এক নাগাড়ে বলে গেলেন। মনে হয়েছে তিনি কোনাে নিঃশ্বাসই নেননি এতক্ষণ। সাজিদ বলল- ‘অদ্ভুত তাে। তাহলে তাে আমাকে আবার নাস্তিক হয়ে যেতে হবে দেখছি। হা হা হা হা। সাজিদ চমৎকার একটা হাসি দিল। বিপ্লবদা সেদিকে মনােযােগ দিয়েছেন বলে মনে হলাে না। উনি মােটামুটি একটা লেকচার শুরু করেছেন। আমি আর সাজিদ খুব মনােযােগী ছাত্রের মতাে উনার বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুনছিলাম। তিনি যা বােঝালেন, তার সারসংক্ষেপ ঠিক এরকম। -“পদার্থবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মােচন করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সে একটি থিওরি আছে, সেটি হতে, ‘কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান। এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মূল কথা হলাে, মহাবিশ্বে পরম শূন্যস্থান বলে আদতে কিছু নেই। মানে, আমরা যেটাকে ‘Nothing’ বলে এতদিন জেনে এসেছি, বিজ্ঞান বলছে, আদতে ‘Nothing’ বলতে কিছুই নেই। প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই, যখনই কোনাে শূন্যস্থান (Nothing) তৈরি হয়, সেখানে এক সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে কণা এবং প্রতিকণা (Matter & Anti-Matter) তৈরি হচ্ছে এবং একটির সাথে অন্যটির ঘর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তােমরা কি জানাে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের ধারণা কোথা থেকে এসেছে? আমি বললাম-না। বিপ্লবদা আবার বলতে শুরু করলেন-এই ধারণা এসেছে হাইজেনবার্গের বিখ্যাত ‘অনিশ্চয়তা নীতি’ থেকে। হাইজেনবার্গের সেই বিখ্যাত সূত্রটা তােমরা জানাে নিশ্চয়?” সাজিদ বলল-“হ্যাঁ। হাইজেনবার্গ বলেছেন, আমরা কখনও একটি কণার অবস্থান এবং এর ভরবেগের সঠিক পরিমাণ একসাথে একুরেইটলি জানতে পারব না। যদি অবস্থান সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর ভরবেগের মধ্যে গলদ থাকবে। আবার যদি ভরবেগ সঠিকভাবে জানতে পারি, তাহলে এর অবস্থানের মধ্যে গলদ থাকবে। দুটো একই সাথে সঠিকভাবে জানা কখনােই সম্ভব না। এটা যে সম্ভব না। এটা বিজ্ঞানের অসাড়তা নয়, আসলে এটা হলাে কণার ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য। বিপ্লবদা বললেন-এক্সাক্টলি। একদম তাই। হাইজেনবার্গের এই নীতিকে শক্তি আর সময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। হাইজেনবার্গের এই নীতি যদি সত্যি হয়, তাহলে মহাবিশ্বে শূন্যস্থান বলে কিছু থাকতে পারে না। যদি থাকে, তাহলে তার অবস্থান ও ভরবেগ দুটোই শূন্য চলে আসে, যা হাইজেনবার্গের নীতিবিরুদ্ধ।এইটুকু বলে বিপ্লবদা একটু থামল। কফির পট থেকে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন-বুঝতেছাে তােমরা? সাজিদ বুঝছে কিনা জানি না, তবে আমার কাছে ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও, বিপ্লবদার উপস্থাপন ভঙ্গিমা সেটাকে অনেকটাই প্রাঞ্জল করে তুলছে। ভালাে লাগছে। বিপ্লবদা কফিতে চুমুক দিলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন-“তাহলে তােমরা যে বলাে, বিগ ব্যাং-এর আগে তাে কিছুই ছিল না। না সময়, না শক্তি, না অন্যকিছু। তাহলে বিগ ব্যাং-এর বিস্ফোরণটি হলাে কীভাবে? এর জন্য নিশ্চয় কোনাে শক্তি দরকার? কোনাে বাহ্যিক বল দরকার, তাই না? এটা বলে তােমরা স্রষ্টার ধারণাকে জায়েজ করতে। তােমরা বলতে, এই বাহ্যিক বলটা এসেছে স্রষ্টার কাছ থেকে। কিন্তু দেখাে, বিজ্ঞান বলছে, এখানে স্রষ্টার কোনাে হাত নেই। বিগ ব্যাং হবার জন্য যে-শক্তি দরকার ছিল, সেটা এসেছে এই কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান থেকে । সুতরাং, মহাবিশ্ব তৈরিতে স্রষ্টার অস্তিত্বকে বিজ্ঞান সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছে। আর তােমরা এখনাে স্রষ্টা স্রষ্টা করে কোথায় যে পড়ে আছাে, তা আমি বুঝতে পারি না। এতটুকু বলে বিপ্লবদার চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে, উনি যে-উদ্দেশ্যে আমাদের ডেকেছেন তা সফল হয়ে গেছে। আমরা হয়তাে উনার বিজ্ঞানের উপর এই জ্ঞানগর্ভ লেকচার শুনে এক্ষুণি নাস্তিকতার উপর ঈমান নিয়ে আসব। যাহােক, ইতােমধ্যে সাজিদ দুকাপ কফি গিলে ফেলেছে। নতুন এক কাপ ঢালতে ঢালতে সে বলল-এই ব্যাপারে স্টিফেন হকিংয়ের বই আছে। নাম-‘The Grand Design’। এটা আমি পড়েছি।’ সাজিদের কথা শুনে বিপ্লবদাকে খুব খুশি মনে হলাে। তিনি বললেন-‘বাহ, তুমি তাহলে পড়াশােনা স্টপ করােনি? বেশ বেশ! পড়াশােনা করবে। বেশি বেশি পড়বে। যত পড়বে, তত দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা বাড়বে। সাজিদ হাসল। হেসে সে বলল-কিন্তু দাদা, এই ব্যাপারে আমার কনফিউশান আছে। -কোনাে ব্যাপারে?’, বিপ্লবদার প্রশ্ন। -“স্টিফেন হকিং আর লিওনার্ড স্লোদিনাের বই ‘The Grand Design’-এর ব্যাপারে। বিপ্লবদা একটু থতমত খেলাে মনে হলাে। সম্ভবত মনে মনে বলছেন-এই ছেলে দেখছি খােদার উপর খােদাগিরি করছে। তিনি বললেন-“ক্লিয়ার করাে।সাজিদ বলল-আমি দুই দিক থেকেই এটার ব্যাখ্যা করব। বিজ্ঞান ও ধর্ম। যদি অনুমতি দেন। -“অবশ্যই।’, বিপ্লবদা বললেন। আমি মুগ্ধ শ্রোতা। গুরু আর প্রাক্তন-শিষ্যের তর্ক জমে উঠেছে। সাজিদ বলল-প্রথম কথা হচ্ছে, স্টিফেন হকিংয়ের এই থিওরিটা এখনাে ‘থিওরি’, সেটা ফ্যাক্ট নয়। এই ব্যাপারে প্রথম কথা বলেন বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস। তিনি এটা নিয়ে একটি বিশাল সাইজের বই লিখেছিলেন। বইটার নাম ছিল-‘A Universe From Nothing’। অনেক পরে, এখন স্টিফেন হকিংস এটা নিয়ে উনার ‘The Grand Design’-এ কথা বলেছেন। উনার এই বইটা প্রকাশ হবার পর সিএনএনের এক সাংবাদিক হকিংকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-“আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন? হকিং বলেছিলেন-“ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারে, তবে মহাবিশ্ব তৈরিতে তার প্রয়ােজন নেই। বিপ্লবদা বলল-“সেটাই। উনি বােঝালেন যে, ঈশ্বর মূলত ধার্মিকদের একটি অকার্যকর বিশ্বাস। -হকিং কি বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু হকিংয়ের ঐ বইটি অসম্পূর্ণ। কিছু বিতর্ক আছে। বিপ্লবদা কফির কাপ রাখতে রাখতে বললেন-“বিতর্ক? মানে? -“দাঁড়ান, বলছি। বিতর্ক মানে, উনি কিছু বিষয় বইতে পরিষ্কার করেননি। যেহেতু এটা বিজ্ঞান মহলে প্রমাণিত সত্য নয়, তাই এটা অনেক বিতর্কিত হয়েছে। উনার বইতে যে বিতর্কগুলাে আছে, সেগুলাে ধারাবাহিকভাবে বলছি। বিতর্ক নাম্বার: ০১ হকিং বলেছেন, শূন্য থেকেই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মাধ্যমে বস্তুকণা তৈরি হয়েছে এবং সেটা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে নিউট্রালাইজ হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হলাে-শূন্য বলতে হকিং কি একদম Nothing (কোনােকিছুই নেই) বুঝিয়েছেন, নাকি Quantum Vaccum (বস্তুর অনুপস্থিতি) বুঝিয়েছেন সেটা পরিষ্কার করেননি। হকিং বলেছেন, শূন্যস্থানে বস্তুকণার মাঝে কোয়ন্টাম ফ্লাকচুয়েশান হতে হলে সেখানে মহাকর্ষ বল প্রয়ােজন। কিন্তু ঐ শূন্যস্থানে (যখন সময় আর স্থান তৈরি হয়নি) ঠিক কোথা থেকে এবং কীভাবে মহাকর্ষ বল এল, তার কোনাে ব্যাখ্যা হকিং দেননি।বিতর্ক নাম্বারঃ ০২ হকিং তার বইতে বলেছেন, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে একদম শূন্য থেকে, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মাধ্যমে। তখন সময় (Time)-এর আচরণ আজকের সময়ের এত ছিল না। তখন সময়ের আচরণ ছিল স্থান (Space)-এর এত । কারণ এই ফ্ল্যাকচুয়েশান হওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে সময়ের দরকার ছিল। না, স্থানের দরকার ছিল। কিন্তু হকিং তার বইতে এই কথা বলেননি যে, যে-সময় (Time) মহাবিশ্বের একদম শুরুতে স্থান’-এর মতাে আচরণ করেছে, সেই সময় পরে ঠিক কবে আর কখন থেকে আবার Time-এর মতাে আচরণ শুরু করল এবং কেন?’ আমি বিপ্লবদার মুখের দিকে তাকালাম। তার চেহারার উৎফুল্ল ভাবটা চলে গেছে। সাজিদ বলে যাচ্ছেবিতর্ক নাম্বার: ০৩ ‘পদার্থবিদ্যার যে-সূত্র মেনে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশান হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হলাে, তখন শূন্যাবস্থায় পদার্থবিদ্যার এই সূত্রগুলাে বলবৎ থাকে কী করে?—এটার ব্যাখ্যা হকিং দেননি। বিতর্ক নাম্বার: ০৪ আপনি বলেছেন, প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই শূন্যস্থান পূরণ করতে আপনা-আপনিই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশান হয়ে মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলাে-যেখানে আপনি শূন্যস্থান নিয়ে কথা বলছেন, যখন সময় ছিল না, স্থান ছিল না, তখন আপনি প্রকৃতি কোথায় পেলেন?’ সাজিদ হকিংয়ের বইয়ের পাঁচ নাম্বার বিতর্কের কথা বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লবদা বললেন-“ওকে, ওকে। বুঝলাম। আমি বলছি না যে, এই জিনিসটা একেবারে সত্যি। এটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে। আলােচনা-সমালােচনা হবে। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। তারপর ডিসাইড হবে যে, এটা ঠিক না ভুল।। সাজিদের কাছে বিপ্লবদার এরকম মৌন পরাজয় আমাকে খুব তৃপ্তি দিল। মনে মনে বললাম-ইয়েস সাজিদ, ইউ ক্যান। সাজিদ বলল-“হ্যাঁ, সে পরীক্ষা চলতে থাকুক। যদি কোনােদিন এই থিওরি সত্যিও হয়ে যায়, তাহলেও আমাকে ডাক দিয়েন না দাদা। কারণ আমি কোরআন দিয়েই এটা প্রমাণ করে দিতে পারব। সাজিদের এই কথা শুনে আমার হেঁচকি উঠে গেল। কী বলে? এতক্ষণ যেটাকে গলদপূর্ণ বলেছে, সেটাকে আবার কোরআন দিয়ে প্রমাণ করবে কলহে কীভাবে সব?বিপ্লবদা বুঝল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-কী রকম? সাজিদ হাসল। বলল-শূন্য থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টির কথা আল-কোরআনে বলা আছে দাদা। আমি আরও অবাক হতে থাকলাম। কী বলে এই ছেলে? সে বলল-“আমি বলছি না যে কোরআন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের কথাই বলেছে। কোরআন যার কাছ থেকে এসেছে, তিনি তার সৃষ্টি জগতের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন সেটা বিগ ব্যাং এলেও পাল্টাবে না, কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশান থিওরি এলেও পাল্টাবে না, একই থাকবে।’ বিপ্লবদা বলল-কোরআনে কী আছে বললে যেন? সাজিদ বলল-‘সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে-“যিনি মহাকাশ ও পৃথিবীকে অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে আনেন (এখানে মূল শব্দ বাদি্যু/Originator সেখান থেকেই অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের ধারণা) এবং যখন তিনি কিছু করবার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন শুধু বলেন ‘হও’, আর তা হয়ে যায়। ‘Creator of the heavens and the earth from nothingness, He has only to say when He wills a thing, Be, and it is. ‘দেখুন, আমি আবারও বলছি: আমি এটা বলছি না যে, আল্লাহ তাআলা এখানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশানের কথাই বলেছেন। তিনি তার সৃষ্টির কথা বলেছেন। তিনি অনস্তিত্ব’ (Nothing) থেকে ‘অস্তিত্ব’ (Something) এনেছেন। এমনযে, আল্লাহ তার হাত দিয়ে প্রথমে মহাবিশ্বের ছাদ বানালেন। তারপর তাতে সূর্য, চাঁদ, গ্যালাক্সি এগুলাে একটা একটা করে বসিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল নির্দেশ দিয়েছেন। হকিংও একই কথা বলেছেন। কিন্তু তারা বলছে এটা এমনি এমনি হয়ে গেছে; শূন্য থেকেই। আল্লাহ্ তা’আলা বলছেন, না, এমনি হয়নি। আমি যখন নির্দেশ করেছি ‘হও’ (কুন), তখন তা হয়ে গেল। ‘হকিং ব্যাখ্যা দিতে পারছে না-এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের জন্য মহাকর্ষ বল কোথা থেকে এল; সময় কেন, কীভাবে স্থান হলাে, পরে আবার সেটা সময় হলাে। কিন্তু আমাদের স্রষ্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন হতে, আর তা হয়ে গেল। ধরুন-একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। ম্যাজিশিয়ান বসে আছে স্টেজের এক কোণায়। কিন্তু সে তার চোখের ইশারায় ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দর্শক দেখছে, খালি টেবিলের উপরে হঠাৎ একটা কবুতর তৈরি হয়ে গেল এবং সেটা উড়েওগেল। দর্শক কী বলবে এটা কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশানের মাধ্যমে হয়ে গেছে? না । বলবে না। এর পেছনে ম্যাজিশিয়ানের কারসাজি আছে। সে স্টেজের এক কোণা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা করেছে বলেই এটা হয়েছে। সৃষ্টির এই সূচনার ব্যাপারটাও এমন। তিনি শুধু বলেছেন, হও’, আর মহাবিশ্ব আপনা-আপনিই হয়ে গেল। আপনাদের সেই শূন্যস্থান থেকে স্রষ্টার দূরত্ব কেবল ঐ হও’ পর্যন্তই। মাগরিবের আজান পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লবদাকে অনেকটাই হতাশ হতে। দেখলাম। আমরা বললাম-“আজ তাহলে উঠি?” উনি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন-“এসাে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমি অবাক হয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছি। কে। বলবে এই ছেলেটা গত ছমাস আগেও নাস্তিক ছিল। নিজের গুরুকেই কী রকম কুপােকাত করে দিয়ে এল! কোরআনের সূরা বাকারার ১১৭ নাম্বার আয়াতটি কত শতবার পড়েছি, কিন্তু এভাবে কোনােদিন ভাবিনি। আজকে এটা সাজিদ যখন বিপ্লবদাকে বুঝিয়েছিল, মনে হচ্ছিল আজকেই নতুন শুনছি এই আয়াতের কথা। গর্ব হতে লাগল আমার।চলবে…


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *