প্যারাডক্সিক্যাল_সাজিদ ( দ্বিতীয় পর্ব )

⭐ তাদের অন্তরে আল্লাহ্ মােহর মেরে দেন। সত্যিই কি তাই?

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলাম। সাজিদ পড়ছিল অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ‘The Legacy of Blood’ বইটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর বিদেশি সাংবাদিকের লেখা বই। সাজিদের অনেকদিনের ইচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর সে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করবে। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বই আছে, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে সে। আমি অবশ্য সাজিদকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই রয়ে গেছি। এসব বই-টই পড়ার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট অনীহা আছে। থার্ড পিরিয়ডে সাজিদ ফোন করে বলল ক্লাস শেষে যেন ওর সাথে দেখা করি। দেখা করতে এসেই আটকে গেছি। সােজা নিয়ে এল লাইব্রেরিতে। মােটা মােটা বইগুলাে নিয়ে সে বসে পড়েছে। খুব মনােযােগ দিয়ে পড়ছে আর গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলাে ডায়েরিতে টুকে নিচ্ছে। আমি আর কী করব? সাজিদকে মুখের উপর ‘তুই বসে থাক’ বলে চলেও আসা যাবে না। তাহলেই হয়েছে। আমি ঘুরে ঘুরে সেলফে সাজিয়ে রাখা বইগুলাে দেখছি। হুমায়ূন আহমেদের একটি বই হাতে নিলাম। বইটির নাম-“দিঘির জলে কার ছায়া গাে। হুমায়ূন আহমেদ নামের এই ভদ্রলােক বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় লেখক। যদিও উনার তেমন বই আমি পড়িনি, কিন্তু সাজিদের মুখে উনার বেশ প্রশংসা শুনি। উনার বেশকিছু কালজয়ী চরিত্র আছে। একবার নাকি উনার নাটকের একটি পট পাল্টানাের জন্য মানুষ মিছিল নিয়েও বেরিয়েছিল। বাব্বা! কি সাংঘাতিক! ‘দিঘির জলে কার ছায়া গাে নামের বইটি উল্টাতে লাগলাম। উল্টাতে উল্টাতে একটি জায়গায় আমার চোখ আটকে গেল । বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইনের ব্যাপারে কিছু একটা লেখা। পড়তে শুরু করলামআহসানকে পেয়ে শওকত সাহেব আনন্দিত। তিনি নতুন একটা বই পড়ছেন। বইয়ে বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন সাহেবকে ধরাশায়ী করা হয়েছে। তাঁর পূর্বপুরুষ বানর-এটা তিনি মেনে নিতেই পারতেন না। এখন সমস্যার সমাধান হয়েছে। তিনি আহসানের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন-“তুমি ডারউইনবাদে বিশ্বাস কর? আহসান বলল-“জী চাচা, করি। -তােমার বিশ্বাস তুমি এখন যে কোনাে একটা ভালাে ডাস্টবিন দেখে ফেলে আসতে পারাে।

আহসান বলল- জ্বী আচ্ছা। -“পুরাে বিষয়টা না শুনেই জ্বী আচ্ছা বলবে না। আগে পুরাে বিষয়টা শােনাে। আহসান হতাশভঙ্গিতে পুরাে বিষয়টা শােনার জন্য প্রস্তুত হলাে। সহজে… বিরক্তিকর মানুষটার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। শওকত সাহেব বললেন-“তােমাদের ডারউইনের থিওরি বলে পাখি এসে সরীসৃপ থেকে। তুমি এখন একটা সাপ ও ময়ূর পাশাপাশি রাখাে। চিন্তা কর যে, ময়ূরের পূর্বপুরুষ সাপ, যে সাপ এখন ময়ূয়ের প্রিয় খাদ্য। বলল, তােমার কিছু বলার আছে? -এই মুহূর্তে কিছু বলার নেই চাচা। -মনে মনে দশের ওপরে ৯৫০টা শূন্য বসাও। এই বিশাল প্রায় অসীম সংখ্যা দিয়ে ১ কে ভাগ করাে। কী পাবে জানাে? শূন্য। এটা। হলাে অ্যাটমে অ্যাটমে ধাক্কাধাক্কি করে DNA অণু তৈরির সম্ভাবনা। মিলার নামে কোনাে বিজ্ঞানীর নাম শুনেছাে? ছাগলটাইপ সাইনটিস্ট। -চাচা, শুনিনি। -“ঐ ছাগলটা ১৯৫০ সনে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে অন্য ছাগল সাইন্টিস্টদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। ছাগলটা করেছে কি, ল্যাবরেটরিতে আদি পৃথিবীর আবহাওয়া তৈরি করে ঘন ঘন ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করেছে। কিছু প্রােটিন অণু তৈরি করে বলেছে—এভাবেই পৃথিবীতে প্রাণের শুরু। প্রাণ সৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার কোনাে প্রয়ােজন নেই। এখন সেই ছাগল মিলারকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে হাসাহাসি চলে। Life ম্যাগাজিনে কী লেখা হয়েছিল পড়ে শােনাই। -“চাচা, আরেকদিন শুনি? জটিল কিছু শােনার জন্য আমি এ মুহূর্তে মানসিকভাবে। তৈরি না।’ -“জটিল কিছু বলছি না। জলবৎ তরলং। মন দিয়ে শােনাে। শওকত সাহেব পড়তে শুরু করলেন। আহসান হতাশ চোখে জানালা দিয়ে। তাকিয়ে রইল…….’এতটুকু পড়ে আমি বেশ আনন্দ পেলাম। লেখক হুমায়ূন আহমেদ এখানে ব্যাটা ডারউইনকে একহাত নিলেন। শওকত সাহেবের মতাে আমি কোনােভাবেই মানতে পারি না যে, আমাদের পূর্বপুরুষ বানর। ভারত ঘেন্না লাগে! বইটি নিয়ে আমি সাজিদের কাছে গেলাম। এসে দেখি সে ব্যাগপত্র গােছানাে করেছে। সে বলল-চল, বাসায় যাবাে।

আমি তাকে হাতের বইটি দেখিয়ে বললাম-এই বইটা পড়েছিস? মজার একটি কাহিনী আছে। হয়েছে কি জানিস…? আমার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সাজিদ বলল-শওকত সাহেব নামের এক ভদ্রলােক আহসান নামের একটি ছেলের সামনে ডারউইনের গােষ্ঠী উদ্ধার। করেছে, তাই তাে? আমি অবাক হলাম। বললাম-হ্যাঁ। কিন্তু আমি এই ব্যাপারে বলব কী করে বুঝলি? সাজিদ ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বলল-“এটা ছাড়া এই বইতে আর তেমন বিশেষ কিছু নেই, যেটা দেখাতে তুই এভাবে আমার কাছে ছুটে আসবি। তাই অনুমান করলাম। আমি আর কিছুই বললাম না। বইটি শেলফে রেখে দিয়েই হাঁটা ধরলাম। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ বিপ্লবদার সাথে দেখা। উনার সাথে শেষবারের মতাে দেখা হয়েছিল উনার বাসায়। সেবার সাজিদ আর বিপ্লবদার মধ্যে কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে যা বিতর্ক হয়েছিল, দেখার মতাে। বিতর্কে বিপ্লবদা সাজিদের কাছে গাে হারা হেরেছিল। সেটা ভাবতেই এখনাে আমার পৈশাচিক আনন্দ হয়। আমাদের দেখেই বিপ্লবদা হেসে দিলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন। এর মধ্যে হঠাৎ করে বৃষ্টি চলে এল। মধ্যাকাশে সূর্য্যি মামা তখনও বহাল তবিয়তে জ্বলজ্বল করছে, আবার ওদিকে বৃষ্টির বিশাল বিশাল ফোঁটা। গ্রাম্য লােকজনের কাছে এই বৃষ্টির একটি মজার ব্যাখ্যা আছে। তারা বলে, শিয়ালের বিয়ে হলে এরকম বৃষ্টি হয়। রােদের মধ্যেই বৃষ্টি। শিয়াল প্রজাতির মধ্যে বিয়ের প্রচলন আছে কিনা কে জানে। বিপ্লবদাসহ আমরা ক্যান্টিনে ঢুকলাম। বৃষ্টি কমলে বের হতে হবে। সাজিদ তিন কাপ চা অর্ডার করল। এরপর বিপ্লবদার দিকে তাকিয়ে বলল-দাদা ভাই, চা খেতে অসুবিধে নেই তাে? -না না, ইটস ওকে, বিপ্লবদা উত্তরে বলল। এরপর আবার বিপ্লবদা বলল-“সাজিদ, তােমার সাথে একটি ব্যাপারে আলাপ করার ছিল। ততক্ষণে চা চলে এসেছে। বৃষ্টির মধ্যে গরম গরম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার ফ্লেভারটাই অন্যরকম। সাজিদ তার কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল-হ্যাঁ দাদা, বলুন। কোন টপিক?বিপ্লবদা বলল-“ঐ যে, তােমরা যে বইটাকে স্রষ্টার বাণী বলাে, সেটা নিয়ে। কোরআন। সাজিদ বলল-সমস্যা নেই। বলুন কী বলবেন?” বিপ্লবদা বললেন-কোরআনে একটা সূরা আছে। সূরাটার নাম বাা। সাজিদ বলল-“সূরাটির নাম বাকরা নয়, বাকারা। বাকারা অর্থ-গাভী। ইংরেজিতে The Cow…’ -ওই আর কি। এই সূরার ৬-৭ নাম্বার লাইনগুলাে তুমি কি পড়েছ? -“পুরাে কোরআনই আমরা মাসে কয়েকবার করে পড়ি। এটা মার্ক কিংবা প্লেটোর রচনা নয় যে, একবার পড়া হয়ে গেলেই শেলফে আজীবনের জন্য সাজিয়ে রাখব। বিপ্লবদা বললেন- এই লাইনগুলােতে বলা হচ্ছে:
“Verily, those who disbelieve, it is the same to them whether you warn them or do not warn them, they will not believe. Allah has set a seal on their hearts & on their hearings, and on their eyes there is a covering. Theirs will be a great torment.” (Baqara 6-7)

এরপর বিপ্লবদা সেটার বাংলা অর্থ করে বললেন
নিশ্চয় যারা অস্বীকার করে, তাদের আপনি সাবধান করুন আর না করুন, তারা স্বীকার করবে না। আল্লাহ্ তাদের হৃদয়ে এবং তাদের কর্ণ কুহরে মােহর মেরে দিয়েছেন; তাদের দৃষ্টির ওপর আবরণ টেনে দিয়েছেন। তাদের জন্য আছে ভয়াবহ শাস্তি।”
এইটুকু বলে বিপ্লবদা থামলেন।
সাজিদ বলল- “What’s wrong with these verses?’
বিপ্লবদা বললেন-দেখাে, এখানে বলছে কাফিরদের হৃদয়ে আর কানে তােমাদের আল্লা মােহর আই মিন সিল মেরে দেয়। সিল মারা মানে তালাবদ্ধ করে দেওয়া, তাই না? -হু। -“এখন কাফিরদের হৃদয়ে আর কানে যদি সিল মারা থাকে, তারা তাে সত্যের বাণী, আই মিন তােমরা যেটাকে ধর্মের বাণী বলল আর কি, সেটা বুঝতে পারবে? উপলব্ধি করতে পারবে না। আল্লা যেহেতু তাদের হৃদয়ে আর কানে সিল মেরে দিচ্ছে, তাই তারা ধর্মের বাণীগুলাে বুঝতে পারছে না। তাই তারা কাফির থেকে যাচ্ছে। নাস্তিক হচ্ছে। তাদের কি দোষ বলাে? আল্লাই তাে চান না তারা আস্তিক হােক। চাইলে তিনি নিশ্চয় হৃদয়ে আর কানে সিল মেরে দিতেন না। আবার, শেষে এসে বলছে, তাদের জন্য আজাব অপেক্ষা করছে। এটা কেমন কথা? একদিকে সিল মেরে দিয়ে সত্য বােঝার থেকে দূরে রাখছেন, আবার ওই দিকে আজাবও প্রস্তুত করে রাখছেন। ব্যাপারটা কি ঠিক? বলাে? বিপ্লবদার কথাগুলাে আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হলাে। আসলেই তাে। এই আয়াতগুলাে নিয়ে তাে এভাবে কোনােদিন ভাবিনি।
আল্লাহ একদিকে বলছেন। কাফিরদের অন্তরে মােহর মেরে দেন, আবার তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ব্যাপারটা কী? সাজিদ মুচকি হাসল। চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে বলল-“দাদা, ইসলামের ইতিহাস পড়লে আপনি একশ্রেণির মীরজাফরদের কথা জানতে পারবেন। এরা করত কি জানেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আসত। হাতের মুঠির মধ্যে পাথর নিয়ে বলত-মুহাম্মাদ, আমার হাতে কি আছে বলতে পারলে আমি এক্ষুণি ইসলাম কবুল করব। দেখি তুমি কেমন নবী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসতেন। হেসে বলতেন-তােমার হাতের জিনিসই বলুক সেগুলাে কি। ‘তখন পাথরগুলাে কথা বলতে শুরু করত। এটা দেখে সেই লােকগুলাে খুব অবাক হতাে। অবাক হয়ে বলত-এ তাে সাক্ষাৎ জাদুকর। এই বলে পালাত। অথচ, তারা বলেছিল হাতে কি আছে বলতে পারলে ইসলাম কবুল করবে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পরীক্ষায় পাশ করে গেলে তারা তাকে জাদুকর, জ্যোতিষী ইত্যাদি বলে চলে যেত। মুনাফিকি করত। এসব আয়াতে মূলত এই শ্রেণির কাফিরদের কথাই বলা হয়েছে। যাদের সামনে সত্য উদঘাটিত হওয়ার পরও তারা তা অস্বীকার করে। বিপ্লবদা বললেন-“কিন্তু অন্তরে মােহর মেরে দিয়ে তাদের সত্য জানা থেকে বঞ্চিত। করে, আবার তাদের শাস্তি দেওয়াটা কি ঠিক? -“মােহর আল্লাহ্ ইচ্ছে করে মেরে দেন না। এটা সিস্টেমেটিক্যালি হয়ে যায়। বিপ্লবদা হাসা শুরু করলেন। বললেন-Very Interesting! সিস্টেমেটিক্যালি সিল পড়ে যায়? হা হা হা।
সাজিদের এই কথাটা আমার কাছেও শিশুসুলভ মনে হলাে। সিস্টেমেটিক্যালি সিল পড়ে যায়? আল্লাহ মারেন না। এটা কেমন কথা? আয়াতে তাে স্পষ্টই আছে-“আল্লাহ্ তাদের হৃদয়ে মােহর মেরে দেন। সাজিদ বলল-“দাদা, ধরুন, আমি বললাম, যারা খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, আপনি তাদের খেতে বলুন আর না বলুন, তারা কোনােভাবেই খাবে। না। আল্লাহ্ তাদের দেহ শুকিয়ে দেন। তাদের শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমিয়ে দেন। তাদের জন্য রয়েছে কঠিন অসুখ। খেয়াল করুন-এখানে তারা অসুস্থ হচ্ছে, তাদের শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, তারা কঠিন অসুখে পড়তে যাচ্ছে-কেন এসব হচ্ছে? আল্লাহ্ কি ইচ্ছা করেই তাদের সাথে এগুলাে করছেন? নাহ। এগুলাে তাদের কর্মফল। তাদের যতই জোর করা হােক, তারা যখন কোনােভাবেই খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, তখন সিস্টেমেটিক্যালি না খাওয়ার ফলে তাদের শরীর শুকিয়ে যাবে, শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমে যাবে। তারা কঠিন রােগে পড়বে। এসবকিছুর জন্য তারাই দায়ী। কিন্তু, সিস্টেমটা আল্লাহই চালাচ্ছেন। আল্লাহ একটি সিস্টেম রেডি করে দিয়েছেন। আপনি না খেলে আপনার শরীর আল্লাহ্ শুকিয়ে দেবেন। আপনার শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবেন। দিনশেষে, আপনার একটি কঠিন রােগ হবে। এটা একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমে আপনি তখনই পড়বেন, যখন আপনি নিজ থেকে খাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন।
‘ঠিক সেভাবেই, যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, তাদের সামনে যত প্রমাণ, যত দলিলই আসুক, তারা সত্যকে মেনে নিবে না, অস্বীকার করবেই করবে, তাদের অন্তরে আর কানে সিস্টেমেটিক্যালি একটি সিল পড়ে যাচ্ছে। না খাওয়ার ফলে আপনি যেভাবে শুকিয়ে যান, আপনার শরীরের রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা কমে যায়, আপনার কঠিন অসুখ হয়, ঠিক সেভাবে, বিশ্বাস করবেন না বলে সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছেন, তখন আপনার অন্তরে, কানে সিল পড়ে যাচ্ছে, আর দিন শেষে, আপনার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন অসুখ, আই মিন আজাব। এর জন্য আল্লাহকে ব্লেইম করা হবে কেন? সাজিদ একনাগাড়ে বলে গেল কথাগুলাে। বিপ্লবদার মুখ খানিকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি সম্ভবত বুঝে গেছেন ব্যাপারটা। আমি বললাম-বাব্বা! কী দিয়ে কী বুঝিয়ে দিলি রে ভাই। আমি হলে তাে হ-যব-র-ল করে ফেলতাম।’ সাজিদ মুচকি হাসল। বৃষ্টি অনেকক্ষণ আগেই থেমে গেছে। আমরা বিপ্লবদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম সেদিন।

⭐ মুশরিকদের যেখানেই পাও হত্যা করাে

অতঃপর-নীলাঞ্জনদা মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাংলাদেশি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তি সংগ্রামকে তিনি কোনাে কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নন। সাজিদের সাথে নীলাঞ্জনদার খুবই ভালাে সম্পর্ক। নীলাঞ্জনদাকে আমরা ভালােবেসে নিলুদা বলেই ডাকি। উনি একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আজকে সাজিদের সাথে নিলুদার একটি বিশেষ আলাপ হবে। কয়েকদিন আগে নিলুদা ব্লগে আল কোরআনের একটি আয়াতকে ‘সন্ত্রাসবাদী আয়াত’ বলে কটাক্ষ করে পােস্ট করেছে। সে ব্যাপারে সুরাহা করতে নিজ থেকেই নিলুদার বাসায় যাচ্ছি আমরা। আমরা বিকেল চারটায় নিলুদার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উনার বাসায় এর আগে কখনাে আসিনি। উনার সাথে দেখা হতাে প্রেসক্লাব আর বিভিন্ন প্রােগ্রামে। তবে, উনি যে নীলক্ষেতে থাকেন, সেটা জানি। নীলক্ষেতে এসে সাজিদ নিলুদাকে ফোন দিল। ওপাশ থেকে সুন্দর একটি রিংটোন বেজে উঠল। রিংটোনে সেট করা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের সেই বিখ্যাত ভাষণ।। সাজিদ ফোনের লাউড স্পিকার অন করে দিল। আমরা আবার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর সেই চিরচেনা ভাষণ। বঙ্গবন্ধু বলছেন-“আমরা তাদের ভাতে মারব, আমরা তাদের পানিতে মারব। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। পর পর দুবার রিং হওয়ার পর তৃতীয়বারে নিলুদা ফোন রিসিভ করলেন। সাজিদকে নিলুদা ভালােভাবে বাসার ঠিকানা বুঝিয়ে দিলেন। আমরা ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম। বাইরে থেকে কলিংবেল বাজতেই বুড়াে মতাে এক ভদ্রলােক দরজা খুলে দিল। আমরা ভেতরে গেলাম। বলে নিই, আমরা যে-উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, সেটা নিলুদাকে জানানাে হয়নি। নিলুদার একটি গুণের কথা বলা হয়নি। কবিতা লেখা এবং সাংবাদিকতার পাশাপাশি নিলুদা খুব ভালাে ছবিও আঁকেন। আমরা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই বুড়াে লােকটি আমাদের সােজা নিলুদার রুমে নিয়ে গেল। মনে হয়, উনার উপর এই নির্দেশই ছিল।আমরা নিলুদার রুমে এসে দেখি উনি ছবি আঁকছেন। মুক্তিযুদ্ধের ছবি। প্রায়ই আঁকা হয়ে গেছে। জলপাই রঙা পােশাকের একজন মিলিটারি । মিলিটারির বাম হাতে একটি রাইফেল। একজন অর্ধনগ্ন মহিলা। মহিলার চুল ভােলা। মহিলা বেঁচে নেই। মিলিটারিটা মহিলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে-এরকম কিছু। পাশেই একটি ডাস্টবিন টাইপ কিছু। চারটে কাক বসে আছে সেটার উপর। জয়নুলের ‘দূর্ভিক্ষ’ ছবিটার মতােই। আমাদের দিকে না ফিরেই নিলুদা বললেন-“কিরে, এত ঘটা করে দেখা করতে এসেছিস যে? সাজিদ বলল-“ও মা, তােমার সাথে দেখা হয় না কতদিন, দেখতে মন চাইল বলে চলে এলাম। ডিস্টার্ব করেছি বুঝি? -“আরে না না, তা বলিনি।’, এটুকু বলে নিলুদা ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। আমাকে দেখে নিলুদা বলে উঠল-আরিফ না?’ -হু’, সাজিদ বলল । -“ওরে বাবা! আজ দেখি আমার বাসায় চাঁদের হাট। তুমি তাে জম্পেশ কবিতা লিখাে ভাই আরিফ। বিচিত্রায় তােমার কবিতা আমি প্রায়ই পড়ি। নিলুদার মুখে এরকম কথা শুনে আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। সাজিদ বলল-“জানাে দাদা, তাকে কত করে বলি, বইমেলার জন্যে কবিতার একটা পাণ্ডুলিপি রেডি কর । কিন্তু সে বলে, ওর নাকি ভয় করে। দেখাে তাে দাদা। নিলুদা বলল-“হ্যাঁ হ্যাঁ, পান্ডুলিপি রেডি করাে। একবার বই বের হয়ে গেলে দেখবে ভয়টয় সব দৌড়ে পালাবে। তােমার লেখার হাত দারুণ। আমি পড়ি। তাে। বেশ ভালাে লিখাে। সাজিদ বলল-“দাদা, ওটা কি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ছবি? যেটা আঁকছ? -হু’, নিলুদার উত্তর। -“আচ্ছা দাদা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বিশেষ পড়াশােনা নেই। তুমি তাে আবার এই লাইনের। আজ তােমার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব।’ নিলুদা মুচকি হাসলেন। তুলির শেষ আঁচড়খানা দিয়ে খাটের উপর উঠে বসলেন। আমরা দুজন ততক্ষণে দুটি চেয়ারে বসে পড়েছি। বুড়াে ভদ্রলােক ট্রেতে কফি নিয়ে এসেছেন। নিলুদা কফিতে চুমুক দিতে দিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা শুরু করলেন“১৯৭১ সাল। পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল বাঙালিরা। যখনই তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সােচ্চার হয়েছে, তখনই পাকিস্তানিরা বাঙালিদের উপর চালিয়েছে অত্যাচার, নির্যাতন। নিলুদার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল। মুক্তিযুদ্ধের আলাপ উঠলেই উনি এরকম আবেগপ্রবণ হয়ে যান। তিনি বলে যাচ্ছেন-এই অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা এতই ভয়াবহ হয়ে উঠল যে, বাঙালিরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হলাে । ‘তখন চলছে উত্তাল মার্চ মাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলা ও বাঙালি জাতির কর্ণধার, ইতিহাসের বরপুত্র, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিলেন। সাজিদ বলল-“দাদা, তােমার ফোনের রিংটোন আবার একবার শুনি তাে প্লিজ। আমরা তাদের ভাতে মারব, আমরা তাদের পানিতে মারব। ‘বাবারে! কি সাংঘাতিক কথা।’ নিলুদা কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন-“সাংঘাতিক বলছিস কেন? বরং বল, এটিই হলাে বাঙালির মহাকাব্য। সেদিন এরকম করে বাঙালিদের অনুপ্রাণিত না করলে আমরা কি স্বাধীনতার স্বাদ পেতাম? -“তাই বলে মেরে ফেলার কথা? এটা তাে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মতাে ব্যাপার।’, সাজিদ বলল। নিলুদা বলল-“যেখানে নিজেদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হবার পথে, সেখানে তুই আইন বানাচ্ছিস? যুদ্ধের ময়দানে কোনাে আইন চলে না। -তারপর? -বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিরা ঝাপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। আমি বললাম-“তারা পাকিস্তানিদের মারল এবং মরল, তাই না? -“হ্যাঁ। -যুদ্ধের পরে আমরা তাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব’ অথবা, যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াে’ এরকম কথার জন্য বঙ্গবন্ধুকে কি জেল খাটতে হয়েছে? কিংবা কেউ তাকে সন্ত্রাসের উস্কানিদাতা বা খুনের মদদদাতা হিসেবে ব্লেইম করেছে?’, সাজিদ জিজ্ঞেস করল।-“তাের মাথায় কি গােবর নাকি রে সাজিদ? এটা কোনাে কথা বললি? এটার জন্য। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে ব্লেইম করবে কেন? যুদ্ধের ময়দানে এটা ছিল একজন কমান্ডারের কমান্ড। এটা অপরাধ নয়। বরং এটার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। নির্যাতিত বাঙালিদের মুক্তির দিশারি, মহান নেতা বঙ্গবন্ধ। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেলাম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। একটি স্বাধীন পতাকা। – আমিও একমত। বঙ্গবন্ধু একদম ঠিক কাজটিই করেছেন। আচ্ছা দাদা, ঠিক একই কাজ অর্থাৎ নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, দলিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য পৃথিবীর অন্য কোথাও যদি অন্য কোনাে নেতা এরকম কথা বলে, তাহলে তুমি কি মনে করবে? অন্য কোনাে নেতা যদি বলে-শত্রুদের যেখানেই পাও, হত্যা করাে। আর এই কমান্ডে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি নির্যাতিত মানুষগুলাে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তুমি সেটাকে কোন চোখে দেখবে? -অবশ্যই আমি ঐ নেতার পক্ষে থাকব এবং তার এই কথার, এই কাজের প্রশংসা করব।’, নিলুদা বললেন। -“যেমন? -“যেমন আমি চে গুয়েভারার সংগ্রামকে স্বাগত জানাই, আমি যােসেফ স্ট্যালিন, মাও সে তুংয়ের সংগ্রামকে স্বাগত জানাই। এরা সবাই নির্যাতিতদের অধিকারের জন্য লড়েছেন। এবার সাজিদ বলল-“দাদা, আপনি আরবদের ইতিহাস জানেন? -কী রকম? -“চৌদ্দ শ বছর আগের কথা। আরবের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বিপরীতে একটি। নতুন ধর্মবিশ্বাস সেখানে মাথা তুলে দাঁড়ায়। -হু।’-কিছু মানুষ স্বেচ্চায়, কোনােরকম জোরজবরদস্তি ছাড়াই এই ধর্মটির প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়ে। তারা দলে দলে এই ধর্মবিশ্বাস মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু সমাজপতিদের এটা সহ্য হয়নি। যারা যারা এই ধর্মটিকে মেনে নিচ্ছিলাে, তাদের উপরই নেমে আসছিল অকথ্য নির্যাতন। বুকের উপর পাথর তুলে দেওয়া, ডটের পেছনে রশি দিয়ে বেঁধে মরুভূমিতে ঘুরাননা, গর্দান নিয়ে নেওয়ার এত ঘটনাসহ আরও কত কি। একপর্যায়ে এই ধর্মের প্রচারক এবং তার সঙ্গী-সাথীদের দে” ছাড়া করা হলাে। এমন কোনাে নির্যাতন নেই, যা তাদের উপর নেমে আসে স্বদেশহারা, স্বজনহারা হয়ে তারা তখন বিধ্বস্ত। ৭১-এ আমাদের শত্রু যেমন – পাকিস্তান, ১৪০০ বছর আগের সে সময়টায় মুসলিমদের শত্রু ছিল মুশারক’তাহলে এই অত্যাচার, নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাদের নেতা যদি ঘােষণা দেয়: তােমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও, হত্যা করাে, তাহলে দাদা এতে কি কোনাে অপরাধ, কোনাে সন্ত্রাসবাদ প্রকাশ পায়? নিলুদা চুপ করে আছে। সাজিদ বলে যেতে লাগল-বঙ্গবন্ধুর আমরা তাদের ভাতে মারব, পানিতে মারব’ যদি বাঙালির মহাকাব্য হয়, এটা যদি সন্ত্রাসবাদে উস্কানি না হয়, তাহলে আরেকটি যুদ্ধের ঘােষণাস্বরূপ বলা: ‘তােমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও হত্যা। করাে’ এই কথাটা কেন সন্ত্রাসবাদী কথা হবে? এটি কেন জঙ্গীবাদের উস্কানি হবে? ‘হত্যার নির্দেশ দেওয়ার পরের আয়াতেই বলা আছে: মুশরিকদের কেউ যদি তােমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দাও। ‘আপনি চে গুয়েভারা, যােসেফ স্ট্যালিন, মাও সে তুংয়ের কথা বললেন, তাদের কেউ কি বলেছে: কেউ এসে আমাদের কাছে আশ্রয় চাইলে, আমরা তাদের নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় দেব। বলেছিল? বলেনি। পৃথিবীর কোনাে কমান্ডার শত্রুদের এরকম নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেনি। বরং নির্দেশ দেয়: দেখা মাত্রই গুলি কর। নিলুদা বলল-“হু। সাজিদ বলল-দাদা, কোরআনে আরও আছে, যে বিনা অপরাধে কোনাে নির্দোষ ব্যক্তিকে খুন করল, সে যেন পুরাে মানবজাতিকেই খুন করল। এরকম একটি কথা, পৃথিবীর কোনাে মানুষ, কোনাে নেতা, কোনাে গ্রন্থে কি আছে? নেই । ‘৭১ এ জালিম পাকিস্তানিদের মারার ঘােষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাদের কাছে মহানায়ক, তাহলে ১৪০০ বছর আগে, এরকম ঘােষণা আরেকজন দিয়ে থাকলে, তিনি কেন খলনায়ক হবেন? অপরাধী হবেন? একই কথা, একই নির্দেশের জন্য আপনি একজনকে মহামানব মনে করেন, অন্যজনকে মনে করেন সন্ত্রাসী, কেন দাদা? স্রেফ কি ধর্ম বিরােধিতার জন্য? ‘একজনের এরকম ঘােষণাকে ফোনের রিংটোন করে রেখেছেন, অন্যজনের এরকম ঘােষণাকে সন্ত্রাসবাদী কথাবার্তা, জঙ্গীবাদী কথাবার্তা বলে কটাক্ষ করে লেখা লিখেন, কেন? এটা কি ফেয়ার, দাদা? -হুম। আসলে আমি এমন করে বলিনি।’ নিলুদা কিছুটা একমত। সাজিদ বলল-“দাদা, অনেক নাস্তিককে কোরআনের একটি আয়াতকে অন্য আয়াতের সাথে কন্ট্রাডিক্টরি বলতে দেখেছি। অথচ তারা কোনােদিনও সূরা তাওবায় ‘তােমরা মুশরিকদের যেখানেও পাও হত্যা করাে’ এটাকে সূরা মায়েদার যে নিরাপরাধ কোনাে ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন পুরাে মানবজাতিকেই হত্যা করল’ এটার সাথে কন্ট্রাডিক্টরি বলতে দেখি না।
অথচ সেভাবে ভাবলে, এই দুই আয়াতে দুরকম কথা বলা হচ্ছে। একবার মেরে ফেলতে বলছে, আরেকবার বলছে, মারলে পুরাে মানবজাতিকে হত্যা করার মতাে চরম পাপ হবে। কিন্তু তবুও নাস্তিকরা এই দুটোকে এক পালায় এনে কথা বলে না। কেন বলে না? কারণ তারাও জানে দুটো আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই দুটোকে এক করে বলতে গেলেই নাস্তিকরা ধরা পড়বে, তাই বলে না। নিলুদা সব শুনলেন। শুনে বললেন-এর জন্যই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে এসেছিলি?”। -না দাদা, শুধু ডাবল স্ট্যান্ডবাজিটা উপলব্ধি করাতে এসেছি। হা হা হা। স্রেফ ভালাে সম্পর্ক বলেই নিলুদা সেদিন রাগ করেননি হয়তাে।

⭐ স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল?
ল্যাম্পপােস্টের অস্পষ্ট আলােয় একজন বয়স্ক লােকের ছায়ামূর্তি আমাদের দষ্টিগােচর হলাে। গায়ে মােটা একটি শাল জড়াননা। পৌষের শীত। লােকটা হালকা কাঁপছেও। আমরা খুলনা থেকে ফিরছিলাম। আমি আর সাজিদ। স্টেশন মাস্টারের রুমের পাশের একটি বেঞ্চিতে লােকটা আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে। স্টেশনে এরকম কত লােকই তাে বসে থাকে। তাই সেদিকে আমার বিশেষ কোনাে কৌতুহল ছিল না। কিন্তু সাজিদকে দেখলাম সেদিকে এগিয়ে গেল । লােকটার কাছে গিয়েই সাজিদ ধপাস করে বসে পড়ল। আমি দূর থেকে খেয়াল করলাম, লােকটার সাথে সাজিদ হেসে হেসে কথাও বলছে। আশ্চর্য! খুলনার স্টেশন। এখানে সাজিদের পরিচিত লােক কোথা থেকে এল? তাছাড়া লােকটিকে দেখে বিশেষ কেউ বলেও মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনাে বাদাম বিক্রেতা। বাদাম বিক্রি শেষে প্রতিদিন ঐ জায়গায় বসেই হয়তাে রাত কাটিয়ে দেয়। আমাদের রাতের ট্রেন। এখন বাজে রাত দুটো। এই সময়ে সাজিদের সাথে কারও দেখা করার কথা থাকলে তা তাে আমি জানতামই। অদ্ভুত! আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। একটু অগ্রসর হতেই দেখলাম, ভদ্রলােকের হাতে একটি বইও আছে। দূর থেকে আমি বুঝতে পারিনি। সাজিদ আমাকে ইশারা দিয়ে ডাকল। গৈলাম। লােকটার চেহারাটা বেশ চেনাচেনা লাগছে, কিন্তু সঠিক মনে করতে পারছি না। সাজিদ বলল-এইখানে বস। ইনি হচ্ছেন হুমায়ুন স্যার। হুমায়ুন স্যার? এই নামের কোনাে স্যারকে তাে আমি চিনি না। সাজিদকে জিজ্ঞেস করতে যাবাে যে কোন হুমায়ুন স্যার, অমনি সাজিদ আবার বলল-হুমায়ুন রুবায়েত আজাদকে চিনিস না? ইনি আর কি। এরপর সে লােকটার দিকে ফিরে বলল-“স্যার, এ হলাে আমার বন্ধু, আরিফ। লােকটা আমার দিকে তাকাল না। সাজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমার তখনাে ঘাের কাটছেই না। কী হচ্ছে এসব? আমিও ধপাস করে সাজিদের পাশে বসে গেলাম।সাজিদ আর হুমায়ুন রুবায়েত আজাদ নামের লােকটার মধ্যে আলাপ হচ্ছে। এমনভাবে কথা বলছে, যেন তারা পরস্পর পরস্পরকে অনেক আগে থেকেই চেনে। লােকটা সাজিদকে বলছে-‘তােকে কত করে বলেছি, আমার লেখা আমার অবিশ্বাস’ বইটা ভালােমতাে পড়তে। পড়েছিলি? সাজিদ বলল-“হ্যাঁ স্যার। পড়েছি তাে। -তাহলে আবার আস্তিক হয়ে গেলি কেন? নিশ্চয় কোনাে তাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস? কে সে? নাম বল? পেছনে যে আছে-কী জানি নাম? -“আরিফ… -“হ্যাঁ, এই তাদড়ের ফাঁদে পড়েছিস বুঝি? দাঁড়া, তাকে আমি মজা দেখাচ্ছি…’ এই বলে লােকটা বসা থেকে উঠতে গেল। সাজিদ জোরে বলে উঠল-“না না স্যার। ও কিছু জানে না। -তাহলে? -আসলে স্যার, বলতে সংকোচ বােধ করলেও সত্য এটাই যে, নাস্তিকতার উপর আপনি যেসব লজিক দেখিয়েছেন, সেগুলাে এতটাই দুর্বল যে, নাস্তিকতার উপর আমি বেশি দিন ঈমান রাখতে পারিনি। এটুকু বলে সাজিদ মাথা নিচু করে ফেলল। লােকটার চেহারাটা মুহূর্তেই রুক্ষ ভাব ধারণ করল। বলল-“তার মানে বলতে চাইছিস, তুই এখন আমার চেয়েও বড় পণ্ডিত হয়ে গেছিস? আমার চেয়েও বেশি পড়ে ফেলেছিস? বেশি বুঝে ফেলেছিস? সাজিদ তখনও মাথা নিচু করে আছে।লােকটা বলল-যাক গে ! একটা সিগারেট খাবাে। ম্যাচ নেই। তাের কাছে আছে? -“জি স্যার।’, এই বলে সাজিদ ব্যাগ খুলে একটি ম্যাচ বের করে লােকটার হাতে দিল। সাজিদ সিগারেট খায় না। তবে প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাে তার ব্যাগে থাকে সবসময়। লােকটা সিগারেট ধরাল। কয়েকটা জোরে জোরে টান দিয়ে ফুস করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। ধোঁয়াগুলাে মুহূর্তেই কুণ্ডলি আকারে স্টেশন মাস্টারের ঘরের রেলিং বেয়ে উঠে যেতে লাগল। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। লােকটার কাশি উঠে গেল। কাশতে কাশতে লােকটা বসা থাকে উঠে পড়ল। এই মুহূর্তে উনার সিগারেট খাওয়ার আর ইচ্ছে নেই সম্ভবত। লােকটা সিগারে”েকরােটিকে নিচে ফেলে পা দিয়ে একটি ঘষা দিল। অমনি সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরােটি থেঁতলে গেল। সাজিদের দিকে ফিরে লােকটা বলল-“তাহলে এখন বিশ্বাস করিস যে স্রষ্টা বলে কেউ আছে? সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। -স্রষ্টা এই বিশ্বলােক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন বলে বিশ্বাস করিস তাে? আবারও সাজিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। এবার লােকটা একটা অদ্ভুত রকম হাসি দিল। এই হাসি এতটাই বিদঘুটে ছিল যে, তাতে আমার গা ছমছম করে উঠল। লােকটি বলল-“তাহলে বল দেখি, স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল? এই প্রশ্নটি করে লােকটি আবার সেই বিদঘুটে হাসিটা হাসল। সাজিদ বলল-“স্যার, বাই ডেফিনিশন, স্রষ্টার কোনাে সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে। যদি বলি ‘ক’ সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি করেছে, তৎক্ষণাৎ আবার প্রশ্ন উঠবে, তাহলে ক’ এর সৃষ্টিকর্তা কে? তখন যদি বলি ‘ক’ এর সৃষ্টিকর্তা ‘খ’, তাহলে আবার প্রশ্ন উঠবে ‘খ’ এর সৃষ্টিকর্তা কে? এভাবে চলতেই থাকবে। কোনাে সমাধানে যাওয়া যাবে না।’ লােকটি বলল-“সমাধান আছে। -কী সেটা? -মেনে নেওয়া যে, স্রষ্টা নাই, ব্যস!’, এটুকু বলে লােকটি আবার হাসি দিল। হা হা হা হা। সাজিদ আপত্তি জানাল। বলল-“আপনি ভুল, স্যার। লােকটি চোখ কপালে তুলে বলল-“কী? আমি? আমি ভুল? -জ্বি স্যার।’ -তাহলে বল দেখি, স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল? উত্তর দে। দেখি কত বড় জ্ঞানের জাহাজ হয়েছিস তুই। আমি বুঝতে পারলাম এই লােক সাজিদকে যুক্তির গাঁড়াকলে ফেলার চেষ্টা করছে। সাজিদ বলল-স্যার, গত শতাব্দীতেও বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এই মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে আছে। মানে এটার কোনাে শুরু নেই। তারা আরও ভাবত, এটার কোননা শেষও নেই। তাই তারা বলতঃ যেহেতু এটার শুরু-শেষ কিছুই নেই, সুতরাং এটি জন্য একটা সষ্টিকর্তারও দরকার নেই। কিন্তু থার্মোডাইনামিক্সের তাপ ও গতির সূত্রগুলাে আবিষ্কার হওয়ার পর এই ধারণা পুরােপুরি ভ্যানিশ তাে হয়ই, সাজা পদার্থবিজ্ঞানেও ঘটে যায় একটা বিপ্লব। থার্মোডাইনামিক্সের তাপ ও গতির দ্বিতীয় সূত্র বলছে-এই মহাবিশ্ব ক্রমাগত ও নিরবচ্ছিন্ন উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে পর্যায়ক্রমে উত্তাপহীন অস্তিত্বের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সূত্রকে উল্টো থেকে প্রয়ােগ কখনােই সম্ভব নয়। অর্থাৎ কম উত্তাপ অস্তিত্ব থেকে এটাকে বেশি উত্তাপ অস্তিতের দিকে নিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব নয়। এই ধারণা থেকে প্রমাণ হয়, মহাবিশ্ব চিরন্তন নয়। এটা অনন্তকাল ধরে এভাবে নেই। এটার একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে। থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র আরও বলে, এভাবে চলতে চলতে একসময় মহাবিশ্বের সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে। লােকটি বলল-“উফ! আসছেন বৈজ্ঞানিক লম্পু। সহজ করে বল ব্যাটা।। সাজিদ বলল-“স্যার, একটা গরম কফির কাপ টেবিলে রাখা হলে, সেটা সময়ের সাথে আস্তে আস্তে তাপ হারাতে হারাতে ঠাণ্ডা হতেই থাকবে। কিন্তু সেটা টেবিলে রাখার পর যে-পরিমাণ গরম ছিল, সময়ের সাথে সাথে সেটা আরও বেশি গরম হয়ে উঠবে-এটা অসম্ভব। এটা কেবল ঠাণ্ডাই হতে থাকবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা যাবে, কফির কাপটা সমস্ত তাপ হারিয়ে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র। -“হুম, তাে?’ -এর থেকে প্রমাণ হয়, মহাবিশ্বের একটা শুরু আছে। মহাবিশ্বের যে একটা শুরু আছে-তারও প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের উপর এ যাবৎ যতগুলাে থিওরি বিজ্ঞানীমহলে এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযােগ্য, প্রমাণের দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী থিওরি হলাে-বিগ ব্যাং থিওরি। বিগ ব্যাং থিওরি বলছেঃ মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে একটি বিস্ফোরণের ফলে। তাহলে স্যার, এটা এখন নিশ্চিত যে, মহাবিশ্বের একটি শুরু আছে। লােকটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।সাজিদ আবার বলতে শুরু করল-‘স্যার, আমরা সহজ সমীকরণ পদ্ধতিতে দেখব স্রষ্টাকে সৃষ্টির প্রয়ােজন আছে কিনা, মানে স্রষ্টার সৃষ্টিকর্তা থাকতে পারে কিনা। ‘সকল সৃষ্টির একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে এবং শেষ আছে; ধরি, এটা সমীকরণ ১। ‘মহাবিশ্ব একটি সৃষ্টি; এটাসমীকরণ ২।’এখন সমীকরণ ১ আর ২ থেকে পাইসকল সৃষ্টির শুরু এবং শেষ আছে। মহাবিশ্ব একটি সৃষ্টি, তাই এটারও একটা শুরু এবং শেষ আছে। তাহলে, আমরা দেখলামঃ উপরের দুটি শর্ত পরস্পর মিলে গেল এবং তাতে থার্মোডাইনামিক্সের তাপ ও গতির সূত্রের কোনাে ব্যাঘাত ঘটে নি। -হু -“আমার তৃতীয় সমীকরণ হচ্ছেঃ স্রষ্টা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। ‘তাহলে খেয়াল করুন, আমার প্রথম শর্তের সাথে কিন্তু তৃতীয় শর্ত ম্যাচ হচ্ছে। ‘আমার প্রথম শর্ত ছিল: সকল সৃষ্টির শুরু আর শেষ আছে। কিন্তু তৃতীয় শর্তে কথা বলছি স্রষ্টা নিয়ে। তিনি সৃষ্টি নন, তিনি স্রষ্টা। তাই এখানে প্রথম শর্ত খাটে। সাথে, তাপ ও গতির সূত্রটিও এখানে আর খাটছে না। তার মানে, স্রষ্টার শুরুও নেই, শেষও নেই। অর্থাৎ, তাকে নতুন করে সৃষ্টিরও প্রয়ােজন নেই। তার মানে স্রষ্টার আরেকজন স্রষ্টা থাকারও প্রয়ােজন নেই। তিনি অনাদি, অনন্ত। এতটুকু বলে সাজিদ থামল। হুমায়ুন আজাদ নামের লােকটি কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন-কী ভংচং বুঝলি এগুলাে? কীসব সমীকরণ-টমীকরণ? এসব কি? সােজা সাপ্টা বল। আমাকে অঙ্ক শিখাচ্ছিস? Laws of Causality সম্পর্কে ধারণা আছে? Laws of Causality মতে, সবকিছুর পেছনে একটা Cause বা কারণ থাকে। সেই সূত্র মতে, স্রষ্টার পেছনেও একটা কারণ থাকতে হবে। সাজিদ বলল-“স্যার, উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আমি আপনাকে অঙ্ক শিখাতে যাব কোন সাহসে? আমি শুধু আমার মতাে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছি। -“কছু করেছিস তুই। Laws Of Causality দিয়ে ব্যাখ্যা কর।’, লােকটা উচ্চস্বরে বলল। -স্যার, Laws Of Causality বলবৎ হয় তখনই, যখন থেকে Time, Space এবং Matter জন্ম লাভ করে, ঠিক না? কারণ আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটিও স্বীকার করে যেঃ Time জিনিসটা নিজেই Space আর Matter-এর সাথে কানেক্টেড । Cause-এর ধারণা তখনই আসবে, যখন Time, Space, Matter এই ব্যাপারগুলাে তৈরি হবে। তাহলে যিনিই এই time, Space, Matter-এর স্রষ্টা, তাকে কী করে আমরা Time-SpaceMatter-এর বাটখারাতে বসিয়ে Laws Of Causality দিয়ে বিচার করব, স্যার? এটা তাে লজিকবিরুদ্ধ, বিজ্ঞানবিরুদ্ধ।লােকটা চুপ করে আছে। কিছু হয়তাে বলতে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই আবার সাজিদ বলল-“স্যার, আপনি Laws Of Causality এর যে-সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটা ভুল। লােকটা আবার রেগে গেল। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল-এই ছােকড়া! আমি ভুল বলেছি মানে কী? তুই কি বলতে চাস আমি বিজ্ঞান বুঝি না? সাজিদ বলল-না না স্যার, একদম তা বলিনি। আমার ভুল হয়েছে। আসলে, বলা উচিত ছিল যে, Laws Of Causality-এর সংজ্ঞা বলতে গিয়ে আপনি ছােট্ট একটা জিনিস মিস করেছেন। লােকটার চেহারা এবার একটু স্বাভাবিক হলাে। বলল-“কী মিস করেছি? -“আপনি বলেছেন, Laws Of Causality মতে, সবকিছুরই একটি Cause থাকে। আসলে এটা স্যার সেরকম নয়। Laws Of Causality হচ্ছে: Everything which has a beginning has a cause; অর্থাৎ, এমন সবকিছু, যেগুলাের একটা নির্দিষ্ট শুরু আছে, কেবল তাদেরই Cause থাকে। স্রষ্টার কোনাে শুরু নেই, তাই স্রষ্টাকে Laws Of Causality দিয়ে মাপাটা যুক্তি এবং বিজ্ঞানবিরুদ্ধ। লােকটার মুখ কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল- তুই কি ভেবেছিস, এরকম ভারী ভারী কিছু শব্দ ব্যবহার করে কথা বললেই আমি তাের যুক্তি মেনে নেব? অসম্ভব। সাজিদ এবার মুচকি হাসল। হেসে বলল-“স্যার, আপনার হাতে একটি বই দেখছি। ওটা কী বই? -“এটা আমার লেখা বই: আমার অবিশ্বাস। -স্যার, ওটা আমাকে দেবেন একটু? -এই নে, ধর। সাজিদ বইটা হাতে নিয়ে উল্টাল। উল্টাতে উল্টাতে বলল-“স্যার, এই বইয়ের কোন লাইনে আপনি আছেন? লােকটা ভ্ৰ কুঁচকে বলল-“মানে?” -বলছি, এই বইয়ের কোন অধ্যায়ের, কোন পৃষ্ঠায়, কোন লাইনে আপনি আছেন? -তুই অদ্ভুত কথা বলছিস। আমি বইয়ে থাকব কেন? -কেনাে থাকবেন না? আপনি এর স্রষ্টা না? -হ্যাঁ। -“এই বইটা কালি আর কাগজ দিয়ে তৈরি। আপনিও কি কালি আর কাগজ দিয়ে তৈরি স্যার?আই স্টপিডিটি টাইপ প্রশ্ন। আমি এই বইয়ের স্রষ্টা। এই বই তৈরির সংজ্ঞা দিয়ে কী আমাকে ব্যাখ্যা করা যাবে?জদ আবার হেসে দিল। বলল-“না স্যার। এই বই তৈরির যে-সংজ্ঞা, সেসুজ্ঞা দিয়ে মােটেও আপনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঠিক সেভাবে, এই মহাবিশ্ব যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁকেও তাঁর সৃষ্টির Time-Space-Matter-Cause এসব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আপনি কালি, কলম বা কাগজের তৈরি নন, তার ঊর্ধ্বে। কিন্তু আপনি TimeSpace-Matter-Cause-এর উর্ধ্বে নন। আপনাকে এগুলাে দিয়ে ব্যাখ্যা করাই যায়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন এমন একজন, যিনি নিজেই Time-SpaceMatter-Cause-এর সৃষ্টিকর্তা। তাই তাঁকে Time-Space-Matter-Cause দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। অর্থাৎ তিনি এসবের ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ তার কোনাে Time-Space-Matter-Cause নেই। অর্থাৎ তার কোনাে শুরু-শেষ নেই। অর্থাৎ তার কোনাে সৃষ্টিকর্তা নেই। লােকটা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল-“ভালাে ব্রেইনওয়াশড ! ভালাে ব্রেইনওয়াশড! আমরা কি এই তরুণ প্রজন্ম চেয়েছিলাম? হায়! আমরা কি এই তরুণ প্রজন্ম চেয়েছিলাম? এটা বলতে বলতে লােকটা হাঁটা ধরল। দেখতে দেখতেই উনি স্টেশনে মানুষের ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ছিলাম। ঘড়িতে সময় দেখলাম-রাত দেড়টা বাজে। সাজিদের বিছানার দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আমি উঠে তার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখলাম সে যে বইটা পড়ছে, সেটার নাম-“আমার অবিশ্বাস। বইয়ের লেখক হুমায়ুন আজাদ। সাজিদ বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণায় একটি অদ্ভুত হাসি। আমি বিরাট একটা শক খেলাম। নাহ! এটা হতে পারে না। স্বপ্নের উপর কারও হাত নেই; আমি বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম।

⭐ একটি সাম্প্রদায়িক আয়াত এবং…সেদিন শাহবাগ মােড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমি, সাজিদ, রূপম, মিল, তারেক, শাহরিয়ার আর মিশকাত। সকলেই জানেন, আমাদের মধ্যে সাজিদ হলাে এক্স-এথেইস্ট। আগে নাস্তিক ছিল, এখন আস্তিক। রূপম আর শাহরিয়ার এখনাে নাস্তিক। মার্কস-ই হলাে তাদের ধ্যান-জ্ঞান। মিলু অ্যাগনােস্টিক। স্রষ্টা কি সত্যিই আছে, নাকি আদৌ নেই-সেই ব্যাপারে কোনাে সমাধানে মিলু এখনাে আসতে পারেনি। তারেক, মিশকাত আর আমি, আমরা মােটামােটি কোনাে দিকে যাইনি এখনাে। সপ্তাহের প্রতি রােববারে আমরা এখানে আড্ডা দিই। আড্ডা না বলে এটাকে ‘পাঠচক্র বলাই যুতসই। সপ্তাহান্তে এখানে এসে পুরাে এক সপ্তাহে কে কী পড়েছি, পড়ে কী বুঝেছি, কী বুঝিনি এসব আলােচনা করি। ভারী ইংরেজিতে যেটাকে বুক রিভিউ’ বলা হয় আর কি! আজকের আলােচক দুজনঃ শাহরিয়ার আর সাজিদ। শাহরিয়ার আলােচনা করবে প্লেটোর রিপাবলিক’-এর উপর, আর সাজিদ আলােচনা করবে আলকোরআনের উপর। দুজনই তুখােড় আলােচক। রিপাবলিক’ নিয়ে শাহরিয়ারের আলােচনা বেশ জম্পেশ ছিল। রিপাবলিকে প্লেটো নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবােধ, শিষ্টাচার, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সংজ্ঞা, রাষ্ট্রের গঠন, উপাদান, পরিবার, নারী-পুরুষের মনস্তত্ত্ব, সমাজে নারী-পুরুষের মূল্যায়ন ইত্যাদির উপর যে-সবিস্তার আলােচনা করেছিলেন, শাহরিয়ার খুবই চমৎকারভাবে তার সারসংক্ষেপ আমাদের সামনে তুলে ধরল। মনে হচ্ছিলঃ খােদ প্লেটোই যেন আমাদের সামনে আঙুল উঁচিয়ে উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন জিনিসটার কী ব্যাখ্যা, কী কাজ, কী ধর্ম। শাহরিয়ারের আলােচনা শেষ হলে সাজিদ তার আলােচনা শুরু করে। সেও আলকোরআন নাজিল হওয়ার কারণ, এতে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, নারী-পুরুষ এবং এতদসংক্রান্ত যে-বিষয়গুলাে আছে তার একটি চমৎকার সংক্ষিপ্ত আলােচনা তুলে ধরল। আলােচনা শেষ করার আগে সাজিদ এই বলে শেষ করল যেঃ “আলকোরআন নাজিল হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য। এটি শুধু মুসলিমদের জন্য নয়। আমাদের সুশীল পরিভাষায় যেটাকে অসাম্প্রদায়িক বলে আর কি।, এতটুকু বলে সাজিদ থামল।জেনের আলােচনাই বেশ প্রফুল্ল ছিল। কিন্তু গণ্ডগোেল পাকাল রূপম। সাজিদ আল-কোরআনকে অসাম্প্রদায়িক বই বলেছে-এটা সে মেনে নিতে পারেনি। বলে নিই, রূপম সাজিদের ক্লাসমেট। তাই দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটি আমি-তুমি বা আপনি নয়; তুই-তুকারির সম্পর্ক। রূপম খুবই অবজ্ঞার সুরে সাজিদকে উদ্দেশ্য করে বলল-কোরআন অসাম্প্রদায়িক, এটাও আমাকে শুনতে হলাে, হা হা হা হা। সাজিদ বলল-“হ্যাঁ। অবশ্যই। এরপর রূপম বলল-কোরআনের সাম্প্রদায়িক আয়াত মনে হয় তুই এখনাে পড়িসনি। তাই জানিস না।’ -“আমি না পড়ে থাকলে তুই পড়ে আমাকে শােনা’, সাজিদ বলল। রূপম ইংরেজিতে সূরা আলে-ইমরানের ১১৮ নং আর আল মায়েদার ৫১ নং আয়াতটি পড়ে শােনাল। সাথে অনুবাদ করেও পড়ল। সে বললO you, who believe! do not take for intimate friends from among others than your own people’ অর্থ: “হে বিশ্বাসীরা! তােমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরাে না। দেখ! কোরআনই তােদের বলছে, আমাদের, মানে অমুসলিমদের বন্ধুরূপে না নিতে। আর তুই কিনা এখানে কোরআনকে অসাম্প্রদায়িকতার সার্টিফিকেট দিচ্ছিস। হাস্যকর না? এটা অসাম্প্রদায়িকতার নতুন সংজ্ঞা বুঝি? অমুসলিমদের বন্ধু বানাবা না, খবরদার! -হা হা হা। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। অবজ্ঞার সুরে বললেও রূপমের কথা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতাে নয়। অপেক্ষা করছি সাজিদের উত্তরের জন্য। সাজিদ একটু ঝেড়ে কেশে নিল। এরপর বলতে শুরু করলদেখ রূপম! কোরআন নাজিল হয়েছে হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর। এখন কোরআনের আয়াতগুলােকে আমাদের বুঝতে হবে ঠিক সেভাবে, যেভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝিয়েছেন। প্লেটোর রিপাবলিক তুই তাের মনমতাে ব্যাখ্যা করতে পারিস না বা বুঝে নিতে পারিস না। তােকে ঠিক সেভাবেই বুঝতে হবে, যেভাবে প্লেটো বুঝিয়েছেন। এতটুকু তাে কমন সেন্সের ব্যাপার, তাই না? রূপম বলল–হুম।

এখন কোরআনকেও আমরা সেভাবেই বুঝব, যেভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝিয়েছেন। প্রথমে তুই যে আয়াতের কথা বললি, সেই আয়াতে আসি। ঐ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আমাদের বলেছেনঃ অমুসলিমদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতে। এখানে আল্লাহ তাআলা বন্ধু’ শব্দটার জন্য যেঅ্যারাবিক ওয়ার্ডটি ব্যবহার করেছেন, তা হলাে আউলিয়া’। রাইট? রূপম বলল-“হতে পারে। আমি আরবি বুঝি না। রূপমের আরবি বােঝার কথাও না। সে হিন্দু ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা। ব্লগে মুক্তমনা নামধারী নাস্তিকদের লেখালেখি পড়ে কোরআন নিয়ে যা একটু জানে। সাজিদ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল-“আরিফ, মােবাইল খুলে কোরআনের অ্যাপস থেকে আয়াতটি তিলাওয়াত করে শােনা। আমি শুনালাম। রূপম বিশ্বাস করল যে, সেই আয়াতে ‘বন্ধু’ শব্দের জন্য আরবি ‘আউলিয়া’ শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। সাজিদ বলল-“শুনলি? -হ্যাঁ। -এখন, আমরা এটাকে ব্যাখ্যা করব। অ্যারাবিকে ‘আউলিয়া’ শব্দটির জন্য দুটি অর্থ করা যায়। একঃ বন্ধু, দুইঃ অভিভাবক। আমরা এখানে সেই অর্থটা নেব, যেটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণ হয়ে আসবে। ‘তার আগে দুটি বিষয় ক্লিয়ার করি। আউলিয়া শব্দের জন্য বন্ধু আর ‘অভিভাবক’ দুই অর্থ করা গেলেও এই দুই শব্দের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। বন্ধু মানে বন্ধু। এই যেমন, তুই আমার বন্ধু। আমি তাের সাথে এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছি, খাচ্ছি। অনেক রাত একসাথে ঘুমিয়েছি। ক্লাস করি একসাথে। আবার আমার বাবা-মা’ও আমার বন্ধু। কিন্তু, তুই আর আমার বাবা-মা কি একই রকম বন্ধু? নাহ। পার্থক্য আছে। তারা আমার অভিভাবক, বন্ধু। তাের সাথে বন্ধুত্বের যে-ডেফিনিশন, তাদের সাথে সামথিং মাের দ্যান দ্যাট, রাইট? রূপম মাথা নাড়ল। সাজিদ আবার বলতে লাগল‘আমার বাবা-মা আমার যাবতীয় সিক্রেট জানে। আমার দুর্বলতা কোথায় জানে।। তুই জানিস? -নাহ।এবার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনীতে যা, তুই সেখানে দেখবিং তিনি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করেছেন। অমুসলিমদের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য করেছেন। তাদের সাথে খেয়েছেন, কাজ করেছেন, কত কি। মানে। এখন আমি যা যা তাের সাথে করি, অনেকটা সে-রকম। তাই না ? আমাদের সবাই মাথা নাড়লাম। রূপমও মাথা নাড়ল। -তাহলে দেখা যাচ্ছে, ঐ আয়াতে আউলিয়া অর্থে আমরা বন্ধু’ শব্দটা নিতে পারব না। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা যদি ‘আউলিয়া’ শব্দটি দ্বারা বন্ধুই বােঝাতেন, তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনােই অমুসলিমদের সাথে ওঠাবসা করতেন না। তাহলে প্রশ্ন এখানে, আউলিয়া’ শব্দের কোন অর্থ বােঝানাে হয়েছে? হ্যাঁ, এখানে আউলিয়া’ শব্দ দিয়ে বােঝানাে হয়েছে অভিভাবক। আল্লাহ্ আমাদের বলেছেন, “হে বিশ্বাসীরা! তােমরা অমুসলিমদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ কোরাে না। একজন অভিভাবক হলাে সে-ই, যে আমাদের যাবতীয় গােপন খবর জানবে, আমাদের শক্তি, আমাদের কৌশল, আমাদের দুর্বলতা জানবে। এখন আল্লাহ্ বলেছেন, অমুসলিমদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ কোরাে না। মানে, অমুসলিমদের কাছে তােমরা তােমাদের সিক্রেট বলে দিয়াে না। কারণ এতে কোনাে এক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। বিপদ হতে পারে। -কী রকম বিপদ?’, তারেক জিজ্ঞেস করল। সাজিদ বলল-যেমন, ইসলামের প্রথম জিহাদ কোনটি? বদর যুদ্ধ, তাই না? -হ্যাঁ।’, আমি বললাম। -সেই যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা কত ছিল? মাত্র ৩১৩ জন। আর প্রতিপক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার, তাই তাে? -হু।’ -আর, সেই যুদ্ধের আগে মুসলিমরা যদি অমুসলিমদের কাছে গিয়ে বলতঃ জানাে, আমরা না মাত্র ৩১৩ জন নিয়ে তােমাদের সাথে লড়ব। এটা কি ঠিক হতাে? নাহ, হতাে না। এই তথ্য ফাঁস হলে কি হতাে? প্রতিপক্ষের মনে সাহস বেড়ে যেত। তারা যুদ্ধে শারীরিকভাবে জেতার আগেই মনস্তাত্ত্বিকভাবে জিতে যেত। এটা কি শুভ হতাে? আজকের দিনে কোনাে দেশ কি এই ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করবে? আমেরিকা কি তার সামরিক শক্তির কথা চীন বা রাশিয়ার কাছে শেয়ারম? করে না। ঠিক একইভাবে আল্লাহও বলছেনঃ “ওদের তােমরা অভিভাবক হিসেবে নিও না।‘এটা একটা সেইফটি। এখানে বন্ধু বানাতে নিষেধ করেনি, অভিভাবক বানাতে নিষেধ করেছে। আমরা চুপ করে আছি। রূপমও কিছু বলছে না। এবার সাজিদ বলল-রূপম, ফার্স্ট ইয়ার থেকেই আমি তাের বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্বের আজকে চার বছর চলছে। এই চার বছরের বন্ধুত্বে তুই কোনােদিন আমাকে তাের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়েছিস? হা হা হা। দিসনি। তাের ক্রেডিট কার্ডের গােপন নাম্বার কোনাে দিন আমায় বলেছিস? বলিসনি। এমনকি কোনাে দিন তাের ফেসবুক পাসওয়ার্ডটিও তাে দিলিনা! হা হা হা। কেন দিলি? কারণ আমি তাের বন্ধু, তাের অভিভাবক না। ‘এখন কি আমি তােকে বলতে পারিঃ রূপম, তুই ব্যাটা আস্ত একটা সাম্প্রদায়িক ফ্রেন্ড, বলতে পারি? হা হা হা। সাজিদ রূপমের মুখের দিকে চেয়ে আছে কোনাে একটি উত্তরের আশায়। রূপম কিছু না বলে ফিক করে হেসে দিল। মনে হচ্ছে সাজিদের কথায় সে খুব মজা পেয়েছে।

কোরআন কি সূর্যকে পানির নিচে ডুবে যাওয়ার কথা বলে?

সাজিদের খুব মন খারাপ। আমি রুমে ঢুকে দেখলাম সে তার খাটের উপর শক্ত। মুখ করে বসে আছে। আমি বললাম, ক্লাস থেকে কখন এলি? সে কোনাে উত্তর দিল না। আমি কাঁধ থেকে সাড়ে দশ কেজি ওজনের ব্যাগটি নামিয়ে রাখলাম। টেবিলের উপর। তার দিকে ফিরে বললাম, কী হয়েছে রে? মুখের অবস্থা নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটনের মতাে করে রেখেছিস। সে বলল-ট্রাইটন দেখতে কী রকম? -“আমি শুনেছি ট্রাইটন দেখতে নাকি বাংলা পাঁচের মতাে। আমি জানি, সাজিদ এক্ষুণি একটা ছােটখাটো লেকচার শুরু করবে। সে আমাকে ট্রাইটনের অবস্থান, আকার-আকৃতি, ট্রাইটনের ভূ-পৃষ্ঠে নাইট্রোজেন, কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ, সূর্য আর নেপচুন থেকে ট্রাইটনের দূরত্ব কত-তার যথাযথ বিবরণ এবং তথ্যাদি দিয়ে প্রমাণ করে দেখাবে যে, ট্রাইটন দেখতে মমাটেও বাংলা পাঁচের মতাে নয়। এই মুহূর্তে তার লেকচার বা বকবকানি, কোনােটাই শােনার ইচ্ছে আমার নেই। তাই, যে করেই হােক, তাকে দ্রুত থামিয়ে দিতে হবে। আমি আবার বললাম, ক্লাসে গিয়েছিলি? -হু’ -কোনাে সমস্যা হয়েছে নাকি? মন খারাপ? সে আবার চুপ মেরে গেল। এই হলাে একটা সমস্যা। সাজিদ যেটা বলতে চাইবে না, পৃথিবী যদি ওলটপালট হয়েও যায়, তবু সে মুখ খুলে সেটা কাউকে বলবে না। সে বলল-“কিচেনে যা। ভাত বসিয়েছি। দেখে আয় কী অবস্থা। আমি আকাশ থেকে পড়ার মতাে করে বললাম-ভাত বসিয়েছিস মানে? বুয়া আসেনি? -না। -কেন? -“অসুস্থ বলল। -“তাহলে আজ খাব কি? সাজিদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সেদিকে তাকিয়ে বলল-ভাত বসিয়েছি। *ল যথেষ্ট পরিমাণে পানি আছে। পানি দিয়ে ভাত গিলা হবে।সিরিয়াস সময়গুলােতেও তার এরকম রসিকতা আমার একেবারেই ভালাে লাগে না। অগত্যা কিচেনের দিকে হাঁটা ধরলাম। যেটা ভেবেছি ঠিক সেটা নয়। ভাত বসানাের পাশাপাশি সে ডিমও সিদ্ধ করে রেখেছে। আমার পেছনে পেছনে। সাজিদও এল। এসে ভাত নামিয়ে কড়াইতে তেল, তেলে কিছু পেঁয়াজ কুঁচি হালকা গুঁড়াে মরিচ, এক চিমটি নুন দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে, তাতে ডিম দুটো ছেড়ে দিল। পাশে আমি পর্যবেক্ষকের মতাে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছি। মনে হচ্ছে, সাজিদ কোনাে রান্নার প্রতিযােগিতার প্রতিযােগী, আর আমি চিফ জাস্টিস। অল্প কিছুক্ষণ পরেই ডিম দুটোর বর্ণ লালচে হয়ে উঠল। মাছকে হালকা ভাজলে যেরকম দেখায়, সেরকম। সুন্দর একটি পােড়া গন্ধও বেরিয়েছে। আমি মুচকি হেসে বললাম-খামােখা বুয়া রেখে এতগুলাে টাকা অপচয় করি প্রতিমাসে। অথচ ভুবন বিখ্যাত বুয়া আমার রুমেই আছে। হা হা হা। গােসল সেরে, নামাজ পড়ে, খেয়ে উঠলাম। রুটিন অনুযায়ী, সাজিদ এখন ঘুমােবে। রাতের যে-বাড়তি অংশ সে বই পড়ে কাটায়, সেটা দুপুরবেলা ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেয়। আমার আজকে কাজ নেই। চাইলেই ঘুরতে বেরােতে পারি। কিন্তু বাইরে যা রােদ! সাহস হচ্ছিল না। এরই মধ্যে সাজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটি কচকচানি রয়ে গেল। সাজিদকে এরকম মন খারাপ অবস্থায় আমি আগে কখনাে দেখিনি। কেন তার মন খারাপ সে ব্যাপারে জানতে না পারলে শান্তি পাচ্ছি না। কিন্তু সাজিদকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে কোনাে দিনও বলবে না। ভাবছি কী করা যায়। তখন মনে পড়ল তার সেই বিখ্যাত (আমার মতে) ডায়েরিটার কথা, যেটাতে সে তার জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলাে হুবহু লিখে রাখে। আজকে তার মন খারাপের ব্যাপারটিও নিশ্চয় সে তুলে রেখেছে। তার টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার ডায়েরিটা নিয়ে উল্টাতে লাগলাম। মাঝামাঝিতে এসে পেয়ে গেলাম মূল ঘটনাটা। যে রকম লেখা আছে, সেভাবেই তুলে ধরছি‘পহেলা মে, ২০১৪মফিজুর রহমান স্যার। এই ভদ্রলােক ক্লাসে আমাকে উনার শত্রু মনে করে ঠিক শত্রু না, প্রতিদ্বন্দ্বী বলা যায়। আমাকে নিয়ে উনার সমস্যা হলে * উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের মনে ধৰ্ম, ধমান আল্লাহ, রাসূল ইত্যাদি নিয়ে সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রতিবারই উনার এমন কাজের প্রতিবাদ করি। উনার যুক্তির বিপরীতে এমনও হয়েছে, যুক্তিতে পরাজিত হয়ে উনি ক্লাস থেকেও চলে গিয়েউনার যুক্তির বিপরীতে যুক্তি দিই কয়েকবার। এ কারণে এই বামপন্থি লােকটা আমাকে চক্ষুশূল মনে করেন। সে যাকগে! আজকের কথা বলি। আজকে ক্লাসে এসেই ভদ্রলােক আমাকে খুঁজে বের করলেন। বুঝতে পেরেছি, নতুন কোনাে উছিলা খুঁজে পেয়েছে আমাকে ঘায়েল করার। ক্লাসে আসার আগে মনে হয় পান খেয়েছিলেন। ঠোঁটের এক কোণায় চুন লেগে আছে। আমাকে দাঁড় করিয়ে বড় বড় চোখ করে বললেন-“বাবা আইনস্টাইন, কী খবর? ভদ্রলােক আমাকে তাচ্ছিল্য করে ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকেন। আমাকে আইনস্টাইন ডাকতে দেখে উনার অন্য শাগরেদগণ হাসাহাসি শুরু করল। আমি কিছু না বলে চুপ করে আছি। তিনি আবার বললেন-“শােননা বাবা আইনস্টাইন, তুমি তাে অনেক বিজ্ঞান জাননা, বলাে তাে দেখি, সূর্য কি পানিতে ডুবে যায়? ক্লাস স্তিমিত হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ। আমি মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকালাম। বললাম-“জি না স্যার। সূর্য কখনােই পানিতে ডােবে না। স্যার অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন-ডােবে না? ঠিক তাে? -“জ্বি স্যার। -“তাহলে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় কেন হয় বাবা? বিজ্ঞান কী বলে? আমি বললাম-“স্যার, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘােরার সময়, পৃথিবীর গােলার্ধের যে-অংশটা সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে, সে অংশে তখন সূর্যোদয় হয়; দিন থাকে। ঠিক একইভাবে, পৃথিবীর গােলার্ধের যে-অংশটা তখন সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে, তাতে তখন সূর্যাস্ত হয়; রাত নামে। আদতে, সূর্যাস্ত বা সূর্যোদয় বলে কিছু নেই। সূর্য অস্ত যায় না, উদিতও হয় না। পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে আমাদের এমনটি মনে হয়। স্যার বললেন-বাহ! সুন্দর ব্যাখ্যা। উনি আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন-“তা বাবা, এই ব্যাপারটার উপর তােমার আস্থা আছে তাে? সূর্য পানিতে ডুবে যাওয়াতে বিশ্বাস করাে কি? পুরাে ক্লাসে তখনও পিনপতন নীরবতা। আমি বললাম- না স্যার। সূর্যের ডুবে-টুবে যাওয়াতে আমি বিশ্বাস করি না।’ এরপর স্যার বললেন-‘বেশ! তাহলে ধরে নিলাম, আজ থেকে তুমি আর কোরআনে বিশ্বাস করাে না।স্যারের কথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। পুরাে ক্লাসও সম্ভবত আমার মতােই হতবাক। স্যার মুচকি হেসে বললেন-“তােমাদের ধর্মীয় কিতাব, যেটাকে আবার বিজ্ঞানময় বলে দাবি করাে তােমরা, সেই কোরআনে আছে, সূর্য নাকি পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা। আমি স্যারের মুখের দিকে চেয়ে আছি। স্যার বললেন-“কি বিশ্বাস হচ্ছে না তাে? দাঁড়াও, পড়ে শােনাই। এতটুকু বলে স্যার কোরআনের সূরা কাহফের ৮৬ নাম্বার আয়াতটি পড়ে শােনালেন(চলতে চলতে) এমনিভাবে তিনি (জুলকারনাঈন) সূর্যের অস্ত গমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছালেন, সেখানে গিয়ে তিনি সূর্যকে (সাগরের) কালাে পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন। তার পাশে তিনি একটি জাতিকেও (বাস করতে) দেখলেন, আমি বললাম, হে জুলকারনাঈন! (এরা আপনার অধীনস্ত), আপনি ইচ্ছা করলে (তাদের) শাস্তি দিতে পারেন, অথবা তাদের আপনি সদয়ভাবেও গ্রহণ করতে পারেন। এরপর বললেন-দেখাে, তােমাদের বিজ্ঞানময়’ ধর্মীয় কিতাব বলছে যে, সূর্য নাকি সাগরের কালাে পানিতে ডুবে যায়। হা হা হা। বিজ্ঞানময় কিতাব বলে কথা! ক্লাসের মধ্যে যারা স্যারের মতােই নাস্তিক, তারা হাে হাে করে হেসে উঠল। আমি কিছুই বললাম না। চুপ করে ছিলাম। এতটুকুই লেখা। আশ্চর্য ! সাজিদ, মফিজুর রহমান নামের এই ভদ্রলােকের কথার কোনাে প্রতিবাদ করল না? সে তাে এরকম করে না সাধারণত। তাহলে কি…? আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল সেদিন। এর চার মাস পরের কথা। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় সাজিদ আমাকে এসে বলল-“আগামীকাল ডিপার্টমেন্ট থেকে। ট্যুরে যাচ্ছি। তুইও সাথে যাচ্ছিস।’ আমি বললাম-“আমি? পাগল নাকি? তােদের ডিপার্টমেন্ট ট্যুরে আমি কীভাবে যাব? -“সে ভাবনাটা আমার। তােকে যা বললাম, জাস্ট তা শুনে যা। পরদিন সকাল বেলা বের হলাম। তার ফ্রেন্ডদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। স্যারবৃন্দও আছেন। মফিজুর রহমান নামের ভদ্রলােকটির সাথেও দেখা হলাে। বিরাট গোঁফওয়ালা। এই লােকের পূর্বপুরুষ সম্ভবত ব্রিটিশদের পিয়নের কাজ করত।যাহােক, আমরা যাচ্ছি কুয়াকাটা। পৌঁছতে পাক্কা চার ঘণ্টা সময় লাগল। সারাদিন অনেক ঘােরাঘুরি করলাম। স্যারদের বেশ বন্ধুবৎসল মনে হলাে। ঘড়িতে সময় তখন পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমরা সমুদ্রের কাছাকাছি হােটেলে আছি। আমাদের সাথে মফিজুর রহমান স্যারও আছেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন-গাইজ, বি রেডি! আমরা এখন কুয়াকাটার বিখ্যাত সূর্যাস্ত দেখব। তােমরা নিশ্চয় জাননা, এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সমুদ্র সৈকত, যেখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। আমরা সবাই প্রস্তুত ছিলাম আগে থেকেই। বেরুতে যাব, ঠিক তখনি সাজিদ বলে বসল-স্যার, আপনি সূর্যাস্ত দেখবেন? স্যার বললেন-“Why not! How can I miss such an amazing moment? সাজিদ বলল-“স্যার, আপনি বিজ্ঞানের মানুষ হয়ে খুব অবৈজ্ঞানিক কথা বলছেন। এমন একটি জিনিস আপনি কী করে দেখবেন বলছেন, যেটা আদতে ঘটেই না। এবার আমরা সবাই অবাক হলাম। যে যার চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। স্যার কপালের ভাঁজ দীর্ঘ করে বললেন-What do you want to mean?” সাজিদ হাসল। হেসে বলল-“স্যার, খুবই সােজা। আপনি বলছেন, আপনি আমাদের নিয়ে সূর্যাস্ত দেখবেন। কিন্তু স্যার দেখুন, বিজ্ঞান বুঝে এমন লােক মাত্রই জানে, সূর্য আসলে অস্ত যায় না। পৃথিবীর গােলার্ধের যে-অংশ সূর্যের গােলার্ধের বিপরীত মুখে অবস্থান করতে শুরু করে, সে-অংশটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে হেঁয়ে যায় কেবল। কিন্তু সূর্য তার কক্ষপথেই থাকে। ওঠেও না, ডােবেও না। তাহলে স্যার, সূর্যাস্ত কথাটা তাে ভুল, তাই না? এবার আমি বুঝে গেছি আসল ব্যাপার। মজা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। মফিজুর রহমান নামের লােকটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল-“দেখাে সাজিদ, সূর্য। যে উদিত হয় না আর অস্ত যায় না, তা আমি জানি। কিন্তু, এখান থেকে দাঁড়ালে আমাদের কী মনে হয়? মনে হয়, সূর্যটা যেন আস্তে আস্তে পানির নিচে ডুবে যাচ্ছে। এটাই আমাদের চর্মচক্ষুর সাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। তাই আমরা এটাকে সিম্পলি, সূর্যাস্ত’ নাম দিয়েছি। বলার সুবিধার জন্যও এটাকে সূর্যাস্ত বলাটা যুক্তিযুক্ত। দেখাে, যদি আমি বলতাম-‘ছেলেরা, একটু পর পৃথিবীর গােলার্ধের যে-অংশে বাংলাদেশের অবস্থান, সে-অংশটা সূর্যের ঠিক বিপরীত দিকে মুখ নিতে চলেছে। তার মানে, এখানে এক্ষুণি আঁধার ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামবে।আমাদের সামনে সূর্যটা লুকিয়ে যাবে। চলাে, আমরা সেই দৃশ্যটা অবলােকন করে আসি, আমি যদি এরকম বলতাম ব্যাপারটা ঠিক বিদঘুটে শােনাতাে নিশ্চয়। ভাষা তার মাধুর্যতা হারাতাে। শ্রুতি মধুরতা হারাতাে। এখন আমি এক শব্দেই বুঝিয়ে দিতে পারছি আমি কী বলতে চাচ্ছি, সেটা। সাজিদ মুচকি হাসল। সে বলল-“স্যার, আপনি একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বিজ্ঞান পড়েন, বিজ্ঞান পড়ান। আপনি আপনার সাধারণ চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে পান যে, সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে পানির নিচে। এই ব্যাপারটাকে আপনি সুন্দর করে। বুঝানাের জন্য সূর্যাস্ত নাম দিতে পারেন। তাহলে সূরা কাহূফে জুলকারনাঈন নামের লােকটি এরকম একটি সাগর পারে এসে যখন দেখলঃ সূর্যটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই ঘটনাকে যদি আল্লাহ্ তা’আলা সবাইকে সহজে বুঝানাের জন্য, সহজবােধ্য করার জন্য, ভাষার শ্রুতিমধুরতা ধরে রাখার জন্য, কুলি থেকে মজুর, মাঝি থেকে কাজি, ব্লগার থেকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র থেকে শিক্ষক, সবাইকে সহজে বােঝানাের জন্য যদি বলেন(চলতে চলতে) এমনিভাবে তিনি (জুলকারনাঈন) যখন সূর্যের অস্ত গমনের জায়গায় গিয়ে পৌঁছুলেন, সেখানে গিয়ে তিনি সূর্যকে (সাগরের) কালাে পানিতে ডুবে যেতে দেখলেন। ‘তখন কেন স্যার ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক হবে? কোরআন বলে না যে, সূর্য পানির নিচে ডুবে গেছে। কোরআন এখানে ঠিক সেটাই বলেছে, যেটা জুলকারনাঈন দেখেছে এবং বুঝেছে। আপনি আমাদের সূর্যাস্ত দেখাবেন বলছেন মানে এই না। যে, আপনি বলতে চাচ্ছেন সূর্যটা আসলেই ডুবে যায়। আপনি সেটাই বােঝাতে চাচ্ছেন, যেটা আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি। তাহলে, একই ব্যাপার আপনি পারলে, কোরআন কেন পারবে না স্যার? আপনারা কথায় কথায় বলেন-‘The sun rises in the east & sets in the west এবং বলা হয়ে থাকে এগুলাে ইউনিভার্সাল ট্ৰথ। যেখানে সূর্যের সাথে ওঠা ও ডুবে যাওয়ার কোনাে সম্পর্কই নাই, তখন কীভাবে এগুলাে চিরন্তন সত্য হয় স্যার? এগুলাে আপনাদের কাছে অবৈজ্ঞানিক নয়। আপনারা কথায় কথায় সূর্যোদয়, সুর্যাস্তের কথা বলেন। সেই কথা কেবল কোরআনুল কারীম বললেই চিৎকার করে বলে উঠেনঃ কোরআন অবৈজ্ঞানিক। কেন স্যার?সাজিদ একনাগাড়ে এতসব কথা বলে গেল। স্যারের মুখ কিছুটা পানসে দেখা গেল। তিনি বললেন-“দীর্ঘ চারমাস ধরে এমন একটি সুযােগের অপেক্ষা করছিলে তুমি? আমরা সবাই হেসে দিলাম। সাজিদও হাসল। বড় অদ্ভুত সে হাসি।

⭐ মুসলমানদের কোরবানি ঈদ এবং একজন মাতুব্বরের অযাচিত মাতব্বরি

পদ্মার বুক চিরে আমাদের লঞ্চ চলছে। দুপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সাধারণত, লঞ্চগুলাের মাথার উপর বিশাল সাইজের একটি ছাউনি থাকে। কিন্তু আমাদের লঞ্চটির উপরিভাগ খালি। কোনাে ছাউনি নেই। আকাশটা একদম উদোম। উপরে তারা-নক্ষত্র ভর্তি সুবিশাল আকাশ, নিচে আছে স্রোতস্বিনী পদ্মা।। চাঁদের প্রতিফলিত আলােতে নদীর পানি ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! আমরা যাচ্ছি রসুলপুর গ্রামে। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। সাজিদের অনুরােধ, এবারের কোরবানির ঈদটা তার সাথে তাদের বাড়িতে করতে হবে। তাই যাওয়া। তাছাড়া, যখন শুনলাম পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থলের উপর দিয়ে যাওয়া হবে, তখন আর লােভ সামলানাে গেল না। আমি এর আগে কখনাে এই নদী দুটোকে স্বচক্ষে দেখিনি। তাই বিনা অজুহাতে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। লঞ্চে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ। আমি, সাজিদ এবং একজন লঞ্চ চালক। মধ্যবয়স্ক এই লােকটার নাম মহব্বত আলি। যারা নৌকা চালায় তাদের মাঝি বলা হয়। যারা জাহাজ চালায় তাদের বলে নাবিক। যারা লঞ্চ চালায় তাদের কী বলে? আমি জানি না ।। মহব্বত আলি নামের এই লােক লঞ্চের এক মাথায় জড়ােসড়াে হয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। মাঝিদের মতাে তার বৈঠা চালানাের চিন্তা নেই। তেলের ইঞ্জিন। আমি আর সাজিদ লঞ্চের একেবারে মাঝখানে বসে আছি। একটি চাদর পাতা হয়েছে। সাথে আছে পানির বােতল, চিনা বাদাম, ভাজা মুড়ি। মাথার উপরে আকাশ। হঠাৎ করে আমার তখন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে গেল। আমি সাজিদকে প্রশ্ন করলাম-তুই কি মানিকদার ‘পদ্মা নদীর মাঝি পড়েছিস?” সাজিদ বলল-হু।আমিও কতবার পড়েছি এই উপন্যাস। সব চরিত্রগুলাের নাম আমার ঠিক মনে নেই। তবে উপন্যাসের নায়কের বউটা ল্যাংড়া ছিল এবং নায়কের সাথে তার শ্যালিকার পরকীয়া প্রেম ছিল, এই ঘটনাগুলাে আবছা আবছা মনে করতে পারি। সাজিদ আমাকে বলল-“হঠাৎ উপন্যাসে চলে গেলি কেন? -না, এমনি। এটুকু বলে দুজনে খানিক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। এরপর আমি জিজ্ঞেস করলাম-“আচ্ছা, ঐ উপন্যাসের কোন চরিত্রটি তাের কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছে? আমি ভাবলাম, সাজিদ হয় উপন্যাসের নায়ক কিংবা নায়কের শ্যালিকার কথাই বলবে। কিন্তু সাজিদ বলল-“ঐ উপন্যাসে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার আছে কেবল একটিই। সেটি হলাে হােসেন মিয়া। আমি খানিকটা অবাক হলাম। অবাক হলাম কারণ সাজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও ভাবেনি। কত আগে পড়া একটি উপন্যাস থেকে সে এমন একটি ক্যারেক্টারের নাম বলেছে, যেটি উপন্যাসটির কোনাে মূল চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। হােসেন মিয়া নামে এই উপন্যাসে কোনাে চরিত্র আছে, সেটিই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম-হােসেন মিয়া? নায়ক নয় কেন? সাজিদ বলল-“কুবের মাঝির মতাে কত শত মাঝি পদ্মাপারে অহরহ দেখা যায়, যাদের ঘরে মালার মত একটি খোঁড়া পা-ওয়ালা, কিংবা অন্ধ স্ত্রী আছে, আছে তিন চারটে করে পেটুক সন্তান। আছে কপিলার মতাে সুন্দরী শ্যালিকা। তাদের মাঝেও পরকীয়া আছে, দৈহিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু হােসেন মিয়া? হােসেন মিয়ার মতাে কোনাে চরিত্র আছে এই পদ্ম

Comments are closed.