পুত্র জয়কে দিয়ে নির্বাচনে জয় হবে না

আমরা যখন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতাম, তখন নির্বাচন ছিল ভিন্ন রকমের এবং সাংবাদিকতাও। নির্বাচন এগিয়ে এলে সবগুলো পত্রিকাই ‘ভোট রঙ্গ’ ‘নির্বাচনী রঙ্গ’ জাতীয় কলাম প্রচার করতো। নির্বাচন নিয়ে এখন আর রঙ্গ হয় না, এখন শুধু রক্ত ঝরে। মিডিয়া সাংবাদিকরা মালিকপক্ষের চাকরি করেন। মালিকদের সমৃদ্ধি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। রুটি-রুজির গরজে সাংবাদিকদের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে সরকারের পক্ষে লড়াই করতে হয়। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা যাঁরা করেন কিংবা বাইরে থেকে যাঁরা কলাম লেখেন, তাঁদের কেউ কেউ সরকার ও শাসকদলের কাছ থেকে অতীতে যেসব বদান্যতা পেয়েছেন এবং বর্তমানেও পেয়ে থাকেন, তাঁরাও রুটি-রুজির গরজে সরকারের তাগিদে রক্তারক্তি করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে তাদের কারো কারো অস্তিত্ব নির্ভর করে এই সরকারের হাজার অন্যায়-অবিচারের যুক্তি সন্ধানের ওপর।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার আর শাসকদলও প্রচুর রক্তারক্তি করেছে। ৫-৬ মে ভোররাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা হয়ে গেল, সেটাও এই নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্ক-বর্জিত নয়। সরকার গদি আঁকড়ে থাকতে চায় বিদেশি প্রভুদের অনুগ্রহে। সে অনুগ্রহ অর্জনের জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।

হেফাজত ইসলামের ২০-৩০ লাখ সমর্থকের শাপলা চত্বরে অবস্থান ধর্মঘট বিদেশি প্রভুদের আতঙ্কিত করে। সুতরাং পাইকারি হত্যা এবং আতঙ্ক দিয়ে এই আন্দোলনকে সাময়িকভাবে হলেও ছত্রভঙ্গ করে দেয়া নিতান্তই প্রয়োজনীয় ছিল সরকারের জন্য। শোনা যায় সে গণহত্যায় বিদেশিরাও মদত দিয়েছিল সরকারের ঘাতক বাহিনীকে।

এই সরকার গোড়া থেকেই ফাউলের ওপর নির্ভর করে রাজনীতির খেলা খেলেছে। সামনাসামনি এবং নিরপেক্ষ খেলার সাহস নেই তাদের। তারা প্রতিপক্ষের হাত পিঠমোড়া বেঁধে লড়াই করতে চায়। বিরোধী দলগুলোর কত হাজার কর্মীকে কয়েদ করে রাখা হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব এই সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না। সত্যতা এবং স্বচ্ছতা এই সরকারের বৈশিষ্ট্য নয়। বিদেশি প্রভুদের মনোরঞ্জনের লক্ষ্যে ইসলামি সন্ত্রাসী কিংবা জামায়াতি বলে কয়েক হাজার টুপি-দাড়িওয়ালা এবং মসজিদে যাওয়া লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। লক্ষণীয় যে, জামায়াতে ইসলামী আজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ দল নয়। কিন্তু পৌনে পাঁচ বছর ধরে শুধু জামায়াতের নেতাকর্মী, এমনকি সাধারণ সদস্য হওয়ার কারণে কয়েক হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের হত্যা করার খবর তো প্রায়ই পাওয়া যায়।

শাসকদল, এমনকি মন্ত্রিসভাতেও এমন এমন লোক আছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের বহু অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। তারা সবাই আওয়ামী দীঘিতে পুণ্যস্নান করে নবজন্ম লাভ করেছেন। এখন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে বিতর্কিত ট্রাইব্যুনালে এবং অধিকতর বিতর্কিত পদ্ধতিতে বিচার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির দণ্ড দেয়া হচ্ছে। একজনকে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ায় সরকারি উসকানিতে তাদের কর্মীরা এবং শাহবাগে সরকারের অবৈধ সন্তানরা ‘ফাঁসি ফাঁসি’ ধ্বনি তুলে রক্তলিপ্সা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। বিএনপির দুই প্রৌঢ় নেতাও আছেন এই তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়ায় আসামির তালিকায়। দেশে এবং বিদেশে সেজন্যই এই বিচারকে বলা হচ্ছে রাজনৈতিক বিচার।

হুকুমের আসামির বিচার ভবিষ্যতেও হবে : কারাবন্দি বিএনপি নেতাকর্মীর সংখ্যা আরো বেশি। এই সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সোয়া সাত হাজার দুর্নীতির মামলা মওকুফ করে দিয়েছে। খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি সব ধরনের মামলা ছিল তার ভেতর। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ডজন দুয়েক আসামিকে রাষ্ট্রপতির নামে মুক্ত করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিগ-২৯ এবং কোরিয়া থেকে ফ্রিগেট ক্রয় ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যাপারে দুর্নীতির পাঁচটি মামলা ছিল সে তালিকায়। কিন্তু গদি পাওয়ার পর থেকে বিএনপি ও অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভুয়া মামলা সাজিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের সব মানুষই জানেন ককটেল, বোমা নিক্ষেপ, গাড়ি ভাঙা ইত্যাদি কর্ম করে থাকে সর্বনিম্ন স্তরের কর্মীরা এবং হুজুগে পড়ে পাড়ার ও রাস্তার বেকার ছেলেরা।

কিন্তু সচিবালয়ে ককটেল বোমা ছোড়া এবং এয়ারপোর্ট রোডে একটি গাড়ি ভাংচুর করার ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ এ দলের ৪০-৫০ জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকার। অভিযোগ হয়েছে, তাঁরা নাকি ‘হুকুমের আসামি’। এবং এই অলীক অভিযোগে তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে কাশিমপুর জেলে কয়েদ করে রাখা হয়েছে, মাঝে মাঝে ‘রিমান্ডে’ নিয়ে দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তাঁদের ওপর। বাংলাদেশের মানুষ আশা করে আছে কোনো না কোনোদিন অজস্র হত্যা-দুর্নীতি-নির্যাতনের, শাপলা চত্বরের গণহত্যার দায়ে হুকুমের আসামি প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের বিচার হবে।

প্রশাসন আর পুলিশ তো বটেই, বাংলাদেশের দলীয়কৃত আদালত এবং নির্বাচন কমিশনও সরকারের ইচ্ছাপূরণের জন্য সদাই উদগ্রীব। আদালত রায় দিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশন সে রায় পালনের জন্য উদগ্রীব যে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। সরকারের অভিযোগ, জামায়াত নাকি সন্ত্রাসী দল। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশীদের জন্য আমার করুণা হয়। এই দেশ স্বাধীন করার, এদেশের গোড়ার বছরগুলোর সর্বনাশা কর্মকাণ্ডের ইতিহাস জানার সুযোগ তাদের দেয়া হয়নি। কিন্তু যাঁরা সে ইতিহাস মোটামুটিও জানেন, তাঁরা অবশ্যই জানেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, গুপ্তহত্যা এবং পর্বত-প্রমাণ দুর্নীতি আমদানি করেছে আওয়ামী লীগ। অন্য দলগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন। ছোটখাটো আকারে কিছু অপকর্ম তারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই শিখেছে।

জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আসল রহস্য : কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সরকারের প্রকাশ্য যুদ্ধের ইতিহাস অন্যরকমের। ২০০৭-০৮ সালে দু’বছর বাংলাদেশে একটা বর্ণচোরা সামরিক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন মার্কিন নাগরিক ফখরুদ্দীন আহমদ। সে সময় মার্কিন নাগরিক সজীব ওয়াজেদ জয় এবং অন্য একজন মার্কিন নাগরিক কার্ল চিয়াভাচো যৌথভাবে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সে প্রবন্ধে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের গদি সুরক্ষিত করার জন্য যে রূপরেখা দেয়া হয়েছিল, ধর্মীয় রাজনীতি নির্মূল করা ছিল তার একটা প্রধান দিকনির্দেশ। জয় বিদেশে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন এবং সে পরিচয়ে ব্যবসায় করেন। হয়তো তাঁর ‘ডিজিটাল’ পরামর্শেই শেখ হাসিনা গোড়া থেকেই জামায়াতকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, জামায়াতের কোনো ‘সন্ত্রাসে’র কারণে নয়।

সজীব ওয়াজেদ জয় শৈশবে মায়ের সঙ্গে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষাও হয়েছে ভারতের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরো পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান, মার্কিন মহিলাকে বিয়ে করেন এবং মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রচুর বিত্ত-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন তিনি। বস্তুত তাঁর বিপুল সম্পদের উৎস সম্পর্কে মার্কিন ও কানাডীয় সরকার কৌতূহলী। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান প্রশস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর বর্তমান আগ্রহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে বাধ্য।
শেখ-ভগিনীদ্বয়ের সন্তানরা পিতৃপরিচয়ের চাইতে নানার পরিচয়েই পরিচিত হতে ভালোবাসেন। সজীব ওয়াজেদ জয় এবার অন্তত পিতার গ্রামের কথা মনে করেছেন, রংপুরের পীরগঞ্জে দাদার বাড়ি যাওয়ার তাগিদ বোধ করেছেন তিনি। কিন্তু রহস্যটা কারোই জানতে বাকি নেই। জয় পীরগঞ্জ থেকে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, পিতার পরিচয়ে তিনি ভোটভিক্ষা করেছেন।

বাংলাদেশের আইনেও আছে, নির্বাচনপ্রার্থীরা রাষ্ট্রীয় যানবাহন ইত্যাদিসহ কোনো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না। জয় সপরিবারে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে থাকছেন, প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা ভোগ করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি হেলিকপ্টারে পীরগঞ্জ গিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়ি দূরের কথা, স্বামীকেও পাত্তা দিতেন না শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়াকে তিনি তাঁর নিজের বাড়ি সুধাসদন থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে জীবনের অবশিষ্ট বছরগুলো তিনি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অতিথি হয়ে ছিলেন। সাড়ে চার বছর পর এবার হঠাৎ প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার শখ হলো। নির্বাচনের সময় স্বামীর পিত্রালয়ের কথা তার মনে পড়ে ভোটের আশায়। কিন্তু পীরগঞ্জের মানুষ কি এতোই বোকা যে, শ্বশুরবাড়ি এবং দাদার বাড়ির প্রতি হঠাৎ দরদে তারা গলে যাবে?

আওয়ামী লীগ কি বাংলাদেশের : অনেকেই বলেছেন এবং এই লেখক একাধিকবার লিখেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বাত্মক যুদ্ধ নিতান্তই রাজনৈতিক ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের উক্তি থেকে সেটা আরেকবার প্রমাণ হলো। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ে উল্লসিত জয় বলেছেন, ‘জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল আওয়ামী লীগের জন্য অসাধারণ বিজয়।’ ‘জামায়াত বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তানের।’ ‘আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দল; কিন্তু কয়েক বছর যাবৎ এ দলের সমর্থন বাংলাদেশের চাইতে ভারতে বেশি। ভারতীয় নেতারা এখন আর গোপন করেন না যে, যে কোনো মূল্যে তারা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে গদিতে রাখতে চান। জয়ের সর্বশেষ উক্তির পর বাংলাদেশীরা এখন আওয়ামী লীগকে ভারতীয় কোনো দলের শাখা বলে মনে করবে।

নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে আপিলসাপেক্ষ। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে, এখনো বলা যাবে না। কিন্তু মন্ত্রীরা আর আওয়ামী লীগ নেতারা জামায়াতের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেছেন, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। টুকু সাহেব হয়তো স্টুপিড, নয়তো ইতিহাস কাকে বলে তিনি জানেন না। অতীতে এই দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা যেসব লেনদেন করেছেন, সেগুলো তাহলে কিসের ভিত্তিতে হয়েছিল? কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে কি তার মস্তিষ্কে কিছু জ্ঞানের আলো ঢুকবে?

উনিশশ’ ছিয়াশি সালের এপ্রিল মাসে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দল এক বৈঠকে জেনারেল এরশাদের সংসদ নির্বাচন বর্জন করতে একমত হয়েছিল। কিন্তু জামায়াতকে দলে টেনে শেখ হাসিনা সে ঐকমত্য ভঙ্গ করে সে বছরের ৬ মে তারিখের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে জামায়াতকে দলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালুর দাবিতে দেশজোড়া সহিংস আন্দোলন করেছিলেন। সে বছরের জুন মাসের নির্বাচনে সাফল্যের জন্য অধ্যাপক গোলাম আযমের দোয়া চাইতে হাসিনা ইন্দিরা রোডের একটি বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর নবনির্বাচিত সংসদে জামায়াতের চারজন সদস্যের ভোট না পেলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।

বালির উত্তাপ : সূর্য যখন মধ্যাকাশে থাকে, তার উত্তাপে বালি এতোই গরম হয় যে, তাতে পা দেয়া যায় না। কিন্তু সূর্য ডুবলে হিম হয়ে যায় সে বালি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বর্তমানের লমম্ফন-কুর্দন আর হাঁক-ডাকও বালির উত্তাপের মতো। দেশে তাদের কোনো সমর্থন নেই। একটি বিদেশি শক্তির সমর্থনের জোরে এতো বেশি তড়পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু বাংলার সুপ্রাচীন একটি প্রবাদের কথা তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন : ‘চোরের দশদিন আর গৃহস্থের একদিন’। সোফোক্লিসের এক নাটকে একটি সংলাপের অনুবাদ আমি করেছিলাম, ‘কাল হবে অন্যদিন, যে দিনেতে শেষ হবে অতীতের সব অবিচার।’

কিন্তু সেদিনের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশের মানুষকে আরো কিছু অবিচারের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। মনে হচ্ছে, সরকার প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের নির্বাচন কমিশন তো ইতোমধ্যেই জামায়াত নেতাদের প্রার্থিত্ব অবৈধ ঘোষণা করেছে। তারা আশা করছে, লোকদেখানো নির্বাচন করে কোনো রকম একটা ফল ঘোষণা করলেই বিদেশি প্রভুদের খুঁটির জোরে সে ফলাফল তারা বহাল রাখতে পারবে।

এমতাবস্থায় বিএনপি এবং ১৮ দলের উচিত ছিল অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বাধ্য করা, নতুবা সরকারকে উপড়ে ফেলা। সে ভয় সরকারের আছে। সেজন্যই বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর কোনো চেষ্টার ত্রুটি তারা করছে না। মন্ত্রীদের এবং শাসকদলের নেতাদের উল্টাপাল্টা কথাবার্তার সেটাও একটা উদ্দেশ্য। তাঁরা বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাছাড়া শোনা যাচ্ছে, একটা সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীকেও এ লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালের অক্টোবরে বিএনপিকে ভাঙার যে চেষ্টা ডিজিএফআই করেছিল, সেকথা বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে বিএনপি নেতাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

মওদুদ কার উপকার করছেন : বিএনপির আন্দোলন প্রায়ই আমাকে একটা কাহিনী মনে করিয়ে দেয়। বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ডাকাতরা কাচারি ঘরের সামনে আসতেই লোকটা অন্দর মহলে গিয়ে লুকোয়। তারপর ডাকাতরা ঘরে ঢুকলে সে টংয়ে উঠে লুকিয়ে থাকে। এ কাহিনী বন্ধুদের বলার সময় সে বার বার করে বলছিল, ‘আমি কি সাহস ছাড়ি?’ বিএনপির আন্দোলনও সে রকমেরই—তারা কখনো এগোয় আর কখনো পেছায়। খালেদা জিয়া চূড়ান্ত আন্দোলনের কয়েকটি সময়সূচি ঘোষণা করেছিলেন; কিন্তু ঘোষিত সময়ে কিছুই ঘটেনি। তার ওপর নেতাদের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা কর্মী ও সমর্থকদের মনেও হতাশা এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই যথেষ্ট হবে।

বেগম জিয়া ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত ঘোষণা ছিল যে ঈদের পরেই চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে। কিন্তু তার বিদেশে অবস্থানের কয়দিনের মধ্যে সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ কয়েক ধরনের উক্তি করেছেন। তিনি প্রথমে বলেছেন, অক্টোবর মাসে লাগাতার হরতাল করা হবে। তারপরই আবার তিনি বলেছেন সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলন শুরু হবে, প্রয়োজন বোধে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত লাগাতার হরতাল হবে। সাধারণ মানুষ জানে ঈদের পরে আগস্ট মাসেরও প্রায় তিন সপ্তাহ অবশিষ্ট আছে। এ সময়টা বিএনপি নেতারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন?

শেখ হাসিনা যদি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে কিংবা অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন ডেকে বসেন (খুব সম্ভবত সেটাই তাঁর পরিকল্পনা), তাহলে তারপর লাগাতার হরতাল ডেকে কার কী লাভ হবে? মওদুদ সাহেবরা উল্টাপাল্টা সময়সূচি ঘোষণা করে কার উপকার করছেন জানি না; কিন্তু বিএনপির কোনো উপকার তারা করছেন না।

ভবিষ্যতে কী হবে, বাংলাদেশের মানুষের কপালে কী আছে আল্লাহই জানেন। ইতোমধ্যে আপনাদের সবাইকে পবিত্র ঈদের আন্তরিক মোবারক।

Loading


Comments

পুত্র জয়কে দিয়ে নির্বাচনে জয় হবে না — 1 Comment

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *