পুঁজিবাদের অবিচারঃ একটি উদাহরণ

উনিশ শ’ ষাট দশকের একেবারে গোড়ার দিক। আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। তখন মাটির অথবা কালো প্রলেপ দেওয়া কাঠের শ্লেটে মাটির পেন্সিল দিয়ে লিখতাম। পরীক্ষা এলে বাঁশের কঞ্চি চোখা করে দোয়াতে ট্যাবলেট গুলা কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে লিখতাম। ঝরণা কলম তখনো হাতে পাইনি।  এমনি এক দিন স্কুলে আমার পাশে যে ছেলেটি বসত তার পকেটে দেখলাম একটি নতুন কলম। ওই কলম দিয়ে কাগজে একটু লেখার জন্য তাকে অনেক অননয় বিনয় করলাম, সে কলমটি দেখাল কিন্তু আমাকে ছুঁতেই দিল না। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সে আরো বলল, ‘ওই কলমের কালি নাকি কোনোদিন শেষ হবে না, নতুন করে কালি ভরার ঝামেলা ছাড়াই আজীবন একইভাবে ওটা দিয়ে লেখা যাবে’। কচি মনে ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি কোনো ক্রমেই বুঝতে পারলাম না সেটা কেমন করে সম্ভব। অনেক পরে বড় হয়ে বুঝেছিলাম, ওটা ছিল একটি বল-পয়েন্ট কলম।

ঘটনাটি নতুন করে আবার মনে পড়ল মাত্র সেদিন  দৈনিক ইত্তেফাকে শামস সাইদের ‘ফিরে দেখা. বল পেনের ইতিহাস’ শিরোনামে সম্পাদকীয় পাতায় প্রায় আড়াই শ’ শব্দের ছোট্ট একটি লেখা পড়ে। সাইদ লিখেছেন, ‘আমেরিকাতে বলপেন আবিষ্কার হয়েছে ১৯০৯ সালে এবং ১৯২৮ সাল পর্যন্ত এর কোনো উন্নয়ন হয়নি। ওই সময় মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের প্রয়োজনে ঝরনা কলমের পরিবর্তে বল পেনের আধুনিক সংস্করণ তৈরি করে’। লেখাটি পড়ে মনে হল এটা  একেবারেই অসম্পূর্ণ এবং এতে বেশ কিছু তথ্য বিভ্রাটও আছে। গুগল সার্চ দিয়ে বল-পয়েন্ট কলমের যে ইতিহাস আমি পেয়েছি, এই নিবন্ধের মাধ্যমে পাঠকদের জন্য তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি। তার সাথে পুঁজিবাদের একটি নগ্ন দিকও তুলে ধরার চেষ্টা করব।

জন লাউড নামে আমেরিকান এক চামড়া ব্যবসায়ী ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম বল-পয়েন্ট কলমের আদি সংস্করণ তৈরি করে তার পেটেন্ট নেন। উদ্দেশ্য কাগজে লিখা নয়। ট্যান করা চামড়া সোজা করে কাটার জন্য লাইন টানা। পরবর্তী ৩০ বছরে বলপয়েন্ট কলমের আরো ৩৫০টি ভিন্ন ভিন্ন প্যাটেন্ট দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোটিরই বাণিজ্যিকীকরণ সম্ভব হয়নি। কারণ ছিল রিফিলের কালি সমস্যা। পাতলা হলে লিক করত আর ঘন হলে জমে যেত। আবহাওয়া ও তাপমাত্রার তারতম্যে কোনো কোনো সময় একই কালিতে উভয় সমস্যাই দেখা দিত।

লাউডারের মূল প্যাটেন্টের প্রায় ৫০ বছর পর, ১৯৩৫ সালে ল্যাজলো বিরো নামে এক হাঙ্গেরীয়ান ক্যামিস্ট ও তাঁর ভাই জর্জ বিরোর হাতে বলপয়েন্ট কলমের আধুনিক সংস্করণ আবিস্কৃত হয়। বিরো এক সময় একটি সংবাদ পত্র অথবা ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদক হিসাবে তাঁকে নিউজ প্রিন্ট কাগজে অনেক লিখতে হত। ঝরণা কলমের ঘন ঘন কালি ভরতে গিয়ে তিনি বিরক্ত হয়ে পড়েন। তার চেয়ে বড় সমস্যা ছিল ঝরণা কলমের ধারাল নিবের খোঁচায় নিউজ প্রিন্ট কাগজ অহরহ ক্ষত বিক্ষত হয়ে যেত। এই বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য অনেক চিন্তা ভাবনা করে  ল্যাজলো এবং জর্জ যৌথভাবে ঘন কালি এবং কলমের মুখে রোলিং বলের ডিজাইন আবিস্কার করেন।

কিছুদিন পর বিরো ভ্রাতৃদ্বয় ছুটি কাটাতে যান সাগরতীরে। সেখানে দৈবপাকে তাঁদের সাথে দেখা হয়ে যায় সফররত তত্কালিন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট অগস্টিন জাস্টোর সাথে। কথায় কথায় তাঁরা প্রেসিডেন্ট  জাস্টোকে তাঁদের নতুন কলমের মডেল দেখান। জাস্টো বিরো ভাইদের বীরত্বে অভিভূত হয়ে বলেন, ‘তোমরা আর্জেন্টিনাতে এসে এর উত্পাদন শুরু কর’। কয়েক বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তারপর বিরোরা আর্জেন্টিনাতে চলে গেলেন। যাওয়ার পথে প্যারিসে থেমে তাঁরা তাঁদের আবিস্কৃত ডিজাইনের প্যাটেন্ট নিয়ে যান।  কারো কারো মতে, বিরো ভ্রাতৃদ্বয় ১৯৩৮ সালের ১৫ই জুন বৃটিশ সরকার থেকে এই প্যাটেন্ট নেন। প্যাটেন্ট যেখানেই করা হউক না কেন, ১৯৪৩ সালে স্থানীয় বিনিয়োগকারীর সহায়তায় তাঁরা তাঁদের প্রথম কলমের উত্পাদন শুরু করেন আর্জেন্টিনায়। কিন্তু এবারও বলপয়েন্ট কলম সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ কলমের মুখের রোলিং বলের ডিজাইন ডিফেক্টের কারণে ৯০ ডিগ্রী কোণে খাড়া করে না ধরলে কালি বের হচ্ছিল না। আবার কোনো কোনো সময় অতিরিক্ত কালি বেরিয়ে আসছিল। বিরো ভ্রাতৃদ্বয় নিরাশ হলেও হতাশ হলেন না। আবার ল্যাবে ফিরে গেলেন। রোলিং বলে গ্র্যাভিটি নির্ভরতার পরিবর্তে ‘ক্যাপিরস্রি অ্যাকশন’ চালু করেন। বলকে নতুনভাবে ডিজাইন করলেন যাতে একটি মেটেল স্পঞ্জের মত কাজ করে এবং অতিরিক্ত কালি ঝরা বন্ধ হয়।

বিরো ভ্রাতৃদ্বয়ের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে উন্নত কলম উৎপাদিত হল, কাজ করল, বাজারে বিক্রিও হল, কিন্তু যেভাবে জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিল তা হল না।  ইত্যবসরে বিনিয়োগকারীদের মূলধন ফুরিয়ে গেল।  বলপয়েন্ট কলমের নতুন পূণর্যাত্রা আবার থমকে গেল।  তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আর্জেন্টিনাতে কর্তব্যরত  আমেরিকান এয়ার ফোর্সের লোকদের নজরে এল বলপয়েন্ট কলম। ওই কলম দেখে তাঁরা সাথে সাথে ভাবল, প্লেনে উড্ডয়নকালে বলপয়েন্ট কলমের উপযোগিতা ঝরণা কলমের চেয়ে অনেক ভাল এবং বেশি হবে। আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় ঘন ঘন কালি ভরার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এবং কালির অভারফ্লো সমস্যারও সমাধান হয়ে যেতে পারে। তাঁদের মাধ্যমে খবর পেয়ে মার্কিন ফেডারেল সরকার অনেকগুলো কলম কোম্পানির কাছে বলপয়েন্ট কলম উত্পাদনের  জন্য বিরো ভ্রতৃদ্বয়ের ডিজাইন পাঠাল। তার মধ্যে ‘এবাহার্ড ফেবার’ নামে এক আমেরিকান কোম্পানি বিরোদের কাছ থেকে ৫ লক্ষ ডলার দিয়ে বলপয়েন্ট কলমের প্যাটেন্ট রাইট কিনে নিয়ে আরেকটু উন্নত করে তৈরি করার চিন্তা ভাবনা করছে। এমন সময় মিল্টন রেনোল্ডস্ নামে শিকাগোর এক সেলস্ম্যান আর্জেন্টিনা থেকে বিরো মডেলের কলম এনে সমান্য মাঁজাঘসা করে প্যাটেন্ট রাইটের তোয়াক্কা না করে দেদারসে বলপয়েন্ট কলম বানিয়ে বাজারজাত করতে শুরু করেন।

রেনোল্ডসের ব্যবসা যখন জমজমাট তখন, এক পর্যায়ে তার অস্থায়ী কারখানায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করত। মার্কেটিংএর জন্য রেনোল্ডস্ গিম্বলস্ রিটেল স্টোরের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়।  বিরো ভ্রাতদ্বয় আবিস্কার করলেও বলপয়েন্ট কলম রেনোল্ডস্ এবং গিম্বলস্ রিটেল স্টোরের মাধ্যমে আমেরিকা তথা বিশ্বের বাজারে সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৪৫ সালের অক্টোবরের কোনো এক সকালে নিউ ইয়র্কের গিম্বলস্ ডিপার্টমেন্ট স্টোরে একসাথে  ৫ হাজার কাস্টোমার ভীড় জমায় রেনোল্ডস বলপয়েন্ট কলম কিনার জন্য। ওই সময় প্রথমবারের মত এক দোকানে এক দিনে ১০ হাজার বল পেন বিক্রি হয়েছিল। সেদিন প্রতিটি কলমের দাম ছিল সাড়ে বারো ডলার করে। ১৯৪৫ সালের সাড়ে বারো ডলারের বর্তমান মূল্যমান কত হতে পারে পাঠকরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি রেনোল্ডস্ লক্ষ লক্ষ বিরো বলপয়েন্ট কলম বিক্রি করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করেন। আবিস্কার করল হাঙ্গেরীর বিরো ভ্রাতৃদ্বয় আর মজা লুটল শিকাগোর মিল্টন রেনোল্ডস্্। ‘কেউ মরে বিল সেচে কেউ খায় কই’। একেই বলে পুঁজিবাদের অবিচার।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ;
অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি; এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ;

 

Loading


Comments

পুঁজিবাদের অবিচারঃ একটি উদাহরণ — 3 Comments

  1. আবিস্কার করল হাঙ্গেরীর বিরো ভ্রাতৃদ্বয় আর মজা লুটল শিকাগোর মিল্টন রেনোল্ডস্। ‘কেউ মরে বিল সেচে কেউ খায় কই’। একেই বলে পুঁজিবাদের অবিচার।

    কি আর করা যায় পুরা দুনিয়াটাই এখন পুঁজিবাদের কব্জায়।
    আপনার লিখাটা পড়ে ভাল লাগল । আরো আসুক। :smile:<

  2. সংলাপব্লগে স্বাগতম! বলপেন সৃষ্টির ইতিহাস সর্ম্পকে অনেক অজানা তথ্য পেলাম আপনার লিখাতে। অশেষ ধন্যবাদ এ সুন্দর পোষ্টের জন্য।

  3. পড়লাম। লেখার গতিশীলতার জন্য কোথাও আটকে যায় নাই। ভাল লাগলো বলপেন সৃষ্টির ইতিহাস জেনে।
    লেখালেখির জগতে বলপয়েন্ট পেনের বৈপ্লবিক অবদানের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেনা। মানুষ স্মরণ করুক না করুক ইতিহাস সন্ধানী মানুষের কাছে বারো ভাইয়েরা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

    লেখক যদি আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদীদের অগ্রাসন নিয়ে লিখতেন তাহলে দেশের জন্য উপকার হত বৈকি!!! ধন্যবাদ।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *