পিলখানার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালের দিনটিতে জাতির গর্বিত সন্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে আমরা হারিয়েছি, তাই সেই দিনটিকে আমরা মনে রাখতে চাই। পিলখানার ঘটনার বর্ণনায় যাওয়ার আগে একটি সাধারণ প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করা জরুরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুলাংশেই যুগপৎ বর্তমান ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর আদলে গঠিত। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির জনবল এবং স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যথাসম্ভব পরিকল্পিতভাবে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অগোছালো ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা গেলেও সামগ্রিকভাবে ওই সম্পদ বণ্টন নিয়ে কোনো যুদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যক্ত স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদ নিয়েই যাত্রা শুরু।

নবীন বাংলাদেশের নবীন সেনাবাহিনী নিজের নিয়মে এগিয়ে যায়। তবে পাকিস্তান আমল থেকে প্রচলিত অনেকগুলো রেওয়াজ ও ঘটনার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধারণ করতে শুরু করে। এরকম অন্যতম একটি রেওয়াজ ছিল, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর (অথবা সীমান্তরক্ষী বাহিনী) কমান্ড ও কন্ট্রোল তথা নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের ব্যবহার করা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের ডেপুটেশন বা প্রেষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিডিআরে কর্তব্য পালনের জন্য পাঠানো হতো। পাকিস্তান আমলে যেমন, বাংলাদেশ আমলেও, দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তার জন্য প্রতিরক্ষার প্রথম ধাপ ছিল বিডিআর। সেই বিডিআর যেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে পারে, তার জন্যই অপরিহার্য ছিল, বিডিআরের কমান্ড সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসারগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ; ‘নেটওয়ার্ক’ ও ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ নামক শব্দ দুটি মোটামুটিভাবে শিক্ষিত সবার নিকট অতি পরিচিত। এটি শুধু টেলিযোগ বা বেতারযন্ত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযোজ্য নয়, মনের চিন্তাশক্তি ও সেই চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিডিআরের কমান্ড যদি এমন কোনো চরিত্রের অফিসারের ওপর ন্যস্ত হয়, যাদের লেখাপড়া বা প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত চিন্তা সেনাবাহিনী থেকে ভিন্ন, তাহলে বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক এবং ফ্রিকোয়েন্সি মিলবে না। এটা বাস্তবতা হলেও এর বিরুদ্ধে একটি মহল সব সময় দুশ্চিন্তায় থেকেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে একাধিকবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সীমান্তে চোরাচালান রোধ এবং অনুরূপ কর্মে নিয়োজিত করা হয়। সেই সময়ের ঘটনাবলীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কর্তব্যে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অফিসার ও বিডিআরের সেনা-অফিসাররা অসুবিধায় পড়তেন তখনকার আমলের সরকারি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। বাগে আনতে না পেরে একাধিক সেনা অফিসারকে সেই সময় বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। অতঃপর তৎকালীন সরকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনাটি ছিল, বিডিআরের জন্য আলাদা একটি ক্যাডার সৃষ্টি করা হবে। এই মর্মে অফিসারও গ্রহণ করা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রক্রিয়াও এগিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের বাংলাদেশের ইতিহাস যদি পাঠক, (যদি পাঠকের বয়সে কুলায়) নিজের স্মৃতিতে আনেন তাহলে খেয়াল করবেন, জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক একটি নতুন আধা-সরকারি বাহিনীও সরকারের পূর্ণাঙ্গ পৃষ্ঠপোষকতায় অতি দ্রুত কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অফিসিয়ালি নয়; কিন্তু মানসিকভাবে এবং চিন্তা-চেতনায় রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর প্রতিযোগী এবং ভবিষ্যতের বিকল্প মনে করা হতো। রক্ষীবাহিনীতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শুধু চারজন সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন, বাকি একশ’র বেশি অফিসারই ছিলেন রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব ক্যাডার। অর্থাৎ ওই আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব ও সংহতি বহুমুখী আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নিবিড় প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে কোনোমতে বোঝানো সম্ভব হয়েছিল যে, বিডিআরের জন্য নিজস্ব অফিসার-ক্যাডার সৃষ্টি করা একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক তথা আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন।
এখন মূল আলোচ্য বিষয়ে আসি। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে, ঢাকা মহানগরীর পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে একটি বিদ্রোহ হয়েছিল এবং একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। অনুরূপ ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর নগরীর জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক ক্ষুদ্র একটি পার্কে ব্রিটিশ সৈন্যরা মাত্র আধ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে হাজারের অধিক সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছিল; বিস্তারিত লিখতে পারছি না স্থানাভাবে। যা হোক, ওই সময়টায় বিডিআর সপ্তাহ চলছিল। এ উপলক্ষে একাধিক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি সবগুলোতে থাকেননি। বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে সারা দেশ থেকে বিডিআরের সব জ্যেষ্ঠ অফিসার একখানে হয়েছিলেন, সপরিবারে। ২৫ ফেব্র“য়ারি সকালবেলা, পিলখানায় অবস্থিত বিডিআরের বিখ্যাত দরবার হলে, ডাইরেক্টর জেনারেল মহোদয়ের দরবার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। অর্থাৎ সব অফিসার এবং জেসিও ও সৈনিক একখানে সম্মিলিত থাকবে। রূপক অর্থে একটি খাঁচার মধ্যেই সব মুরগি অথবা একটি মাটির হাঁড়ির মধ্যেই সব ডিম। অতএব সেটি ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য একটি মোক্ষম সময়। পিলখানায় নিহতদের (অর্থাৎ শহীদদের) সংখ্যা সঠিকভাবে আবিষ্কার হয়েছে; কিন্তু হত্যাকারীর নাম-ধাম সুস্পষ্টভাবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালেও পিলখানায় একটি বিদ্রোহ হয়েছিল। ’৭২-এর বিদ্রোহ এত লোমহর্ষক ছিল না। তাই কিছুটা প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ পিলখানার ২০০৯ সালের ঘটনার স্মরণ করছি। সর্বাগ্রে, সামরিক ও বেসামরিক তথা সব শহীদ অফিসার, জেসিও, সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। ওই দিনের ঘটনাবলী সম্পর্কে, বিবিধ প্রকারের সংক্ষিপ্ত রচনা, শহীদদের নামের তালিকা, মূল্যায়নমূলক রচনা, ছবি, শোকবার্তা ইত্যাদি অনেক জায়গায় লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষিত আছে।
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সাল পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের নারকীয় ঘটনাটি পুরো জাতির জন্য এক শোকাবহ দিন। এদিন বাংলাদেশের ইতিহাসের তথা পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে একটি অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের ফলে নৃশংসভাবে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মেধাবী তরুণ বা মধ্যবয়সী ৫৭ জন কর্মকর্তা। ঘটনাটি এ দেশের মানুষের চোখের সামনে এখনও ভেসে আছে। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল ওই আমলের বিডিআরের কিছু সংখ্যক ষড়যন্ত্রকারী জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ সৈনিক। দেশের ভেতরের বা বাইরের প্ররোচনাদাতা বা উৎসাহদাতা অবশ্যই ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু তাদের পরিচয় আজও উন্মোচিত হয়নি। ওই ষড়যন্ত্রের রহস্য ও নেপথ্য কাহিনী উদ্ঘাটন হওয়া এবং তা জাতির সামনে উপস্থাপিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটির ধারাবাহিকতায় আরও অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার। কুচক্রীরা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তেমন কিছু করতে না পারলেও ২০০৯ সালে এসে বিডিআরে সেই ঘটনাটি ঘটাতে সক্ষম হয়। বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের কেউ না কেউ মন্দ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত ও উৎসাহিত হয়েছে যে, সেনাবাহিনীর অফিসারদের মারতে হবে। যারা তখন বিডিআরের কিছু সদস্যকে এই অপকর্মে অনুপ্রাণিত করেছে, তারা দেশী শক্তি নাকি বিদেশী শক্তি, তা নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ এখনও আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু তাই বলে এটা প্রমাণ হয় না যে, কোনো অপশক্তি এর পেছনে ছিল না। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করার স্বার্থে, সামরিক বাহিনীর মনোবল ও ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে এ ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মওচন করতেই হবে।
একই সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডটিকে জাতীয়ভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা দরকার। এমন শোকের দিন এই জাতির সামনে খুব কমই এসেছে। এ জন্য আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব, একটি আহ্বান, একটি দাবি হচ্ছে- দিবসটিকে জাতীয়ভাবে শোক দিবস পালনের ঘোষণা করা হোক। এ দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে জাতীয়ভাবে পতাকা অর্ধনমিত রাখার আবেদন করছি। এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ ব্যাপারে জাতীয়ভাবে সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমের প্রতিও আহ্বান জানাই। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সব পত্রপত্রিকায় এ প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনারও আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা যদি বারবার স্মরণ করি, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তাহলে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ধরা পড়বে এবং এতে আগামী প্রজন্ম এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারবে। আমাদের উদ্দেশ্য শোককে শক্তিতে পরিণত করা।
এমন কিছু কাজ আছে যেখানে সব দলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হয় দেশের কথা ভেবে। পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ড তেমনই একটা বিষয়। সুতরাং এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মওচন হওয়া জরুরি। কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনোবল বাড়ানোর স্বার্থে। কাজটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০ বা ৩১ তারিখ পিলখানার ময়দানে বিদ্রোহ হয়েছিল, ঘটনাটিকে শান্তিপূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে পিলখানায় গিয়েছিলেন। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগে বাংলাদেশ আনসার বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কিছু ক্ষুদ্র অংশ বিদ্রোহ করেছিল বগুড়া এবং ঢাকায় এবং তাদের সশস্ত্রভাবে দমন করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অংশ তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মনজুর বীর উত্তমের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিল। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সশস্ত্র পদক্ষেপের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলেও তার আগেই বিদ্রোহ দমন হয়। ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল সেটি হচ্ছে, বিদ্রোহ দমনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা কী?
যা হোক, সেদিনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কোনো কার্পণ্য এ জাতি করেনি এবং ইনশাল্লাহ করবেও না।

(পূর্ব প্রকাশিত: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ যুগান্তর)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *