নবুওয়্যাত ও রিসালাত

নবুওয়্যাত ও রিসালাতের অলঙ্কারে বিভূষিত হবার এক মিনিট আগেও যিনি নবী হবেন তার জানা থাকেনা। মাওলানা আমিন এহসান ইসলাহী যথার্থই বলেছিলেন যে “রিসালাত ও নবুয়াত হচ্ছে মোহাব্বতে রব্বানী” বা আল্লাহর ভালোবাসা ও অনুগ্রহ এবং তা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ার যখন যাকে চান আল্লাহ সে গুরুদায়িত্ব দিয়ে থাকেন। কুরআন আমাদেরকে সে শিক্ষাই দেয়! অবশ্য আল্লাহ ন্যায়বান ও পরম সৎ ব্যক্তিদেরকেই কেবল এ দায়িত্ব দেন।

আমরা জানি মুসা আলাই সালাম মিশরে এক ব্যক্তিকে ভুলবশত হত্যা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন । কিন্তু রাজ্যের পরিষদবর্গ তাকে হত্যা করার পরামর্শ দিচ্ছে জেনে তার পক্ষে সেখানে থাকা সম্ভব ছিল না এবং মাদইয়ান অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। কুরআনে সে ঘটনার বর্ণনা এভাবে এসেছে:

” যখন তিনি মাদইয়ান অভিমুখে রওয়ানা হলেন তখন বললেন, আশা করা যায় আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন। যখন তিনি মাদইয়ানের কূপের ধারে পৌছলেন, তখন কূপের কাছে একদল লোককে পেলেন তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর কাজে রত। এবং তাদের পশ্চাতে দূ’জন স্ত্রীলোককে দেখলেন তারা তাদের জন্তুদেরকে আগলিয়ে রাখছে। তিনি বললেন, তোমাদের কি ব্যাপার? তারা বলল, আমরা আমাদের জন্তুদেরকে পানি পান করাতে পারি না, যে পর্যন্ত রাখালরা তাদের জন্তুদেরকে নিয়ে সরে না যায়। আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ। অতঃপর মূসা তাদের জন্তুদেরকে পানি পান করালেন। অতঃপর তিনি ছায়ার দিকে সরে গেলেন এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষি (কাসাসঃ ২২-২৪)

অতঃপর বালিকাদ্বয়ের পিতা যখন জানলেন যে মুসা তাদের কন্যাদেরকে সাহায্য করেছেন জন্তুদেরকে পানি পান করাতে সে বিনিময়ে মুসাকে পুরস্কার প্রদান করলেন রাখালের চাকুরি দিয়ে এবং মুসার সাথে এক কন্যাকে বিয়ে দিয়ে।
তখনও তিনি জানতেন না যে তিনি একদিন নবী হতে যাচ্ছেন। কিন্ত এক দশ বছর পরে যখন মূছা (আঃ) সেখানে চুক্তিকৃত নির্ধারিত দিন কাটিয়ে পরিবার নিয়ে দেশে রওয়ানা হলেনঃ
“অতঃপর মূসা (আঃ) যখন সেই মেয়াদ পূর্ণ করল এবং সপরিবারে যাত্রা করল, তখন সে তুর পর্বতের দিক থেকে আগুন দেখতে পেল। সে তার পরিবারবর্গকে বলল, তোমরা অপেক্ষা কর, আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি সেখান থেকে তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসতে পারি অথবা কোন জ্বলন্ত কাষ্ঠখন্ড আনতে পারি, যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। (কাসাসঃ ২৯)
তখন আল্লাহ তায়া’লা তাঁর কাছে ওহী পাঠালেনঃ যখন সে তার কাছে পৌছল, তখন পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত উপত্যকার ডান প্রান্তের বৃক্ষ থেকে তাকে আওয়াজ দেয়া হল, হে মূসা! আমি আল্লাহ, বিশ্ব পালনকর্তা। আরও বলা হল, তুমি তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন সে লাঠিকে সর্পের ন্যায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখল, তখন সে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে পালাতে লাগল এবং পেছন ফিরে দেখল না। হে মূসা, সামনে এস এবং ভয় করো না। তোমার কোন আশংকা নেই। তোমার হাত বগলে রাখ। তা বের হয়ে আসবে নিরাময় উজ্জ্বল হয়ে এবং ভয় হেতু তোমার হাত তোমার উপর চেপে ধর। এই দু’টি ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের প্রতি তোমার পালনকর্তার তরফ থেকে প্রমাণ। নিশ্চয় তারা পাপাচারী সম্প্রদায়। (কাসাসঃ ৩০-৩২)

একইভাবে আব্দুল্লাহ পুত্র মোহাম্মদ (স:) কাছে রিসালাত বা নবুয়তের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হবে এবং কোরআন নাজিল হবে সেটিও তিনি আগে জানতেন না এবং তার প্রত্যাশাও ছিল না। এ বিষয়টি কোরানেও বলা আছে।
قُل لَّوْ شَاء اللّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلاَ أَدْرَاكُم بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِّن قَبْلِهِ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ
বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর নাইবা তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না? [ সুরা ইউনুস ১০:১৬ ]

“আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি” এ কথাটি নবীকে বলতে বলা হচ্ছে এটি বুঝাতে বা প্রমাণ দিতে যে নবী মুহাম্মদ এর কাছে কুরআন পৌঁছার আগে এরকম একটি অসাধারণ উচ্চমানের কাব্যিক ভাষা সমৃদ্ধ এজাতীয় তথ্যের ছিটেফোঁটা কথাবার্তা আকারে-ইঙ্গিতেও কি আমার কাছ থেকে আগে প্রকাশ হয়েছে? জীবনে কোন চর্চা বা প্রশিক্ষন ছাড়া এসব কোন মানুষের পক্ষে হঠাৎ জাহির করা সম্ভব নয়।

পৃথিবীর যত বড় কবি দার্শনিক চিন্তাবিদ লেখক ভাল কথা বলেছেন সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু তাদের সবার জীবনে তাদের নিজস্ব জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সফলতার উচ্চতর স্তরে পৌঁছাতে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া থাকে, একটি প্যাটার্ন থকে। অর্থাৎ তারা কেউ রাতারাতি সে অবস্থানে পৌঁছায় না সেজন্য প্রয়োজন হয় অনেক সময় সাধনা ত্যাগ তিতিক্ষা এবং কসরত অতিক্রম করে একদিন তারা সে অবস্থায় পৌঁছান।

কিন্তু “নবুওয়্যাত ও রিসালাতের  ব্যাপারটি আলাদা এখানে কোন ব্যক্তির নিজশ্ব প্রচেষ্টার কোন সুযোগ নাই। সেটি একমাত্র আল্লাহর এখতিয়ার। কাফিরা বরং ঠাট্টা বিদ্রোপ করে বলত যে “আল্লাহ যদি নবীই পাঠাবেন তাহলে তিনি কি তায়েফ মক্কার কোন প্রভাবশালী গোত্রপতি খুঁজে পাননি?”

আরবদের কাছে আরবী ভাষায় কোরআন নাজিলের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন।
আমি একে আরবী ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। [ সুরা ইউসুফ ১২:২ ]
অতঃপর মোহাম্মদ (স) কে আল্লাহ বললেন
نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَـذَا الْقُرْآنَ وَإِن كُنتَ مِن قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِينَ
আমি তোমার নিকট উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি, এ কুরআন আমার ওহী হিসেবে তোমার কাছে প্রেরণ করার মাধ্যমে। যদিও তুমি এর পূর্বে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। [ সুরা ইউসুফ ১২:৩ ]

অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে এটাই আল্লাহ বুঝাতে চাচ্ছেন যে নবীকে তিনি যা জানাচ্ছেন তার কিছুই আব্দুল্লাহ পুত্র মোহাম্মদ (স:) আগে জানতেন না। তিনি ছিলেন একজন সাধারন ব্যবসায়ী মাত্র অবশ্য তার ন্যায়নিষ্ঠ ও পরম সৎ আচার ব্যবহারে সে সমাজের মানুষ তাকে আল আমিন হিসাবে জানত কিন্তু সেটিকে পুজি করে তিনি নিজেকে নবী দাবী করে নিজ থেকে কোরআন রচনা করবেন সে যোগ্যতা তিনি রাখেন না।

অতএব, কোরআন মূলত কিছু আরবি বাক্যের সমন্বয়ে সংকলিত, সুরক্ষিত একখানা গ্রন্থ এ কথাটি কি কুরআন সম্পর্কে বলা যথেষ্ট হবে?
কুরআন শুরুতেই তার বর্ণনা দেয় যে এটি একটি নির্ভেজাল সত্যিকারের ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় বাণী যা এসেছে বিশ্ব স্রষ্টার কাছ থেকে । কিন্তু এ কুরআন নিজেকে একটি কিতাব দাবি করলেও সাধারণত কিতাব বলতে আমরা কারো লেখা বই-পুস্তক যেভাবে বুঝি কুরআন ঠিক সেভাবে লিখিত কোন কিতাব নয়। এটি এমন একটি সমাজে নাযিল হয়েছিল যেখানে অক্ষরজ্ঞানসংপন্নতার মানুষ খুবই স্বল্প ছিল অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ছিল নিরক্ষর। সে সমাজে প্রতিভাবান ব্যক্তিরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা ভাবনা, দার্শনিক চিন্তা চেতনা ও মনোভাবনা কবিতা ও কাব্য আকারে প্রকাশ করতেন এবং এটাই ছিল তখনকার রেওয়াজ বা প্রথা । সেটি ছিল একটি মৌখিক সমাজ বা “ওরাল সোসাইটি” যেখানে কোন তথ্য লিখিতভাবে প্রকাশ হত না তেমন একটা বরং লোকমুখে প্রচার করাটাই ছিল বড় মাধ্যম। তবে কুরআন যখন নাজিল হত তখন উপস্থিত কোরআনে বিশ্বাসী অর্থাৎ রাসুলের সাথী বা সাহাবিদের হুবহু সে বানীগুলো লিখে রাখতেও তাগিদ দিতেন। আমরা জানি একটি বই প্রকাশের আগে লেখকের লিখাগুলো এডিট করার যে সুযোগ থাকে তা কোরআনের বেলা সেটি ছিল না এবং দরকারও হয়নি। কুরানের বাক্যগুলো যখন রাসুলের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সেটিই ছিল ফাইনাল সেখানে এডিট বা পরিবর্তন করার কোন সুযোগ ছিলনা এবং আজ পর্যন্ত কেউ কোরআনের কোন শব্দের ভুল ধরতেও পারেনি কিংবা কুরআনের মত বক্তব্য তখন কেউ রাখতেও পারেনি।

তাছাড়া আরবী ভাষার ব্যাকরণ এর উৎস হচ্ছে কুরআন। আরবি ব্যাকরণ শিখতে শুরু করেন তখন বুঝতে পারবেন আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি। এ পৃথিবীর এমন কোন লেখক আছেন কি যিনি এ দাবি করতে পারেন যে তার রচিত পুস্তকটি চিরদিন সংরক্ষিত থাকবে বা থাকতে পারে? কিন্তু কুরআনের রচয়িতা কোরআনকে চিরন্তন সংরক্ষিত করে রাখার ওয়াদা নিজেই করেছেন। এ দাবি কেবল তিনিই করতে পারবেন যিনি নিজে চিরঞ্জীব আর তিনিই হচ্ছেন আপনার আমার প্রভু এ বিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *