দ্রুত সংলাপ ও সমঝোতা বনাম মহা বিপর্যয়

পাকিস্তানে গত বৃহস্পতিবার একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে বলা যায়। তালেবানদের চার সদস্যের একটা প্রতিনিধিদল ইসলামাবাদে সরকারের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তিন ঘণ্টা ধরে শান্তি আলোচনা শুরু করেছে। আলোচনায় উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করা হয়নি। হবে বলে কেউ আশাও করেনি। দুটি প্রতিনিধিদল শুধু পরস্পরের মতামত জেনে নিয়েছে। তবু ‘আলোচনার জন্য আলোচনার’ যে সূত্রপাত হয়েছে, বরফের প্রাচীর যে গলতে শুরু করেছে, সেটাকে অনেকেই আশার লক্ষণ বিবেচনা করছেন।
কিছুকাল ধরেই শোনা যাচ্ছিল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ আলোচনার মাধ্যমে তালেবানদের সঙ্গে মীমাংসায় আসতে আগ্রহী। তালেবানরাও নিশ্চয়ই অনুকূল সাড়া দিয়েছিল। তারা প্রথমে ক্রিকেট তারকা থেকে রূপান্তরিত রাজনীতিক ইমরান খানকে তাদের প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইমরান খান শেষ পর্যন্ত রাজি হননি। এ নিয়ে কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। মনে হচ্ছে উভয় পক্ষই এখন বুঝে গেছে, আলোচনার মাধ্যমে ছাড়া শান্তি আসবে না এবং শান্তি স্থাপিত না হলে পাকিস্তানের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হবে।
পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের সূচনা ভারতবর্ষের বিভক্তির অব্যবহিত পর থেকেই শুরু হয়েছে বলা চলে। পাঞ্জাবি আমলা ও সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে একটা উপনিবেশ হিসেবে শাসন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। সংবিধান প্রণয়নে অযথা বছরের পর বছর বিলম্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে ২৩ বছর কোনো জাতীয় নির্বাচন হয়নি। কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নিয়ে উচ্চাভিলাষী সেনানায়করা রাজনীতিকদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। সে লক্ষ্যে তারা হাত-কাটা, পা-কাটা, মাথা-কাটা নানা ধরনের উদ্ভট গণতন্ত্র উদ্ভাবনের প্রয়াস পান। অন্যদিকে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাজনীতিকরাও নিজেদের অধিকার ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। পরিণতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে একটা ত্রিমুখী কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী সেন্টো (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন) ও সিটো (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন) সামরিক চুক্তি পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ দুর্ভাগ্যে চতুর্থ একটা মাত্রা যোগ করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আফগানিস্তান দখল করে ছিল। আফগানরা বহু দল-উপদল আর গোষ্ঠীতে বিভক্ত। সনাতনী কাল থেকে তাদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ এবং যুদ্ধ লেগেই থাকে। কিন্তু সে জাতির একটা বৈশিষ্ট্য, কোনো বিদেশি হানাদার এলে বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করে। রুশদের বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি। রুশ সৈন্যদের ওপর তারা আক্রমণ করেছে, শত শত রুশ ট্যাঙ্ক-হাতবোমা আর রকেট দিয়ে ধ্বংস করেছে, রুশ হেলিকপ্টার, এমনকি রুশ জঙ্গি বিমানও গুলি করে নামিয়েছে। তালেবানরা আগে থেকেই এই প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সৌদি আরব আর পাকিস্তানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থ ও অস্ত্র চালান দিয়েছে। রুশবিরোধী গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রই ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছিল।
কোনো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা কিংবা স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধে অন্য দেশের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য লাভ নতুন কথা নয়। সব যুগে সব মহাদেশে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে এসেছে। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। একাত্তরে আমরা যখন স্বাধীন হতে যুদ্ধ করেছিলাম, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমরাস্ত্র পেয়েছে। প্রয়োজনবোধে ভারতীয় নাগরিকরা তাদের আশ্রয়ও দিয়েছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতবোন নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে অর্ধ শতাব্দী ধরে। সাতবোনের মুক্তিযোদ্ধারা খালি হাতে যুদ্ধ করছে না। তারা কোথাও না কোথাও থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। মধ্য ও পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও বিভিন্ন সূত্রে অস্ত্র পাচ্ছে। কৃতজ্ঞ বাংলাদেশীরা যদি গোপনে সাতবোনের মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সাহায্য দিতে চায় তাহলে বিস্ময়ে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার প্রয়োজন ঘটে না। সে পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় কাউকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া আমার মতে উচিত নয়। বাংলাদেশের মানুষকে খুন করে, তাদের প্রাণদণ্ড দিয়ে ঢাকার সন্দেহজনক বৈধতার সরকার প্রতিবেশীর সমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছে মাত্র।

ওদের অস্ত্র সাহায্য কে দিয়েছিল
সোভিয়েত হানাদারদের বিতাড়নের লক্ষ্যে তালেবান ও আল কায়দাকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের তাবেদার কোনো কোনো উপসাগরীয় দেশ। প্রশিক্ষণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দেয়া হয়েছে আফগানিস্তান সংলগ্ন উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আসন্ন পতনের মুখে মস্কো আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। এবার আল কায়দা এবং তাদের আশ্রয়দাতা কাবুলের তালেবান সরকারকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আফগানিস্তান আক্রমণ করে। এটাও স্বাভাবিক ছিল। অপরাধ জগত্ বিষয়ক উপন্যাস যারা পড়েছেন তারা অবশ্যই জানবেন, আপনি যদি ভাড়া করা খুনি দিয়ে কাউকে খুন করান তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে খুনিকেও খুন করা আপনার জন্য জরুরি হয়ে পড়বে; নইলে সে এবার আপনাকে খুন করার চেষ্টা করবে। বিন লাদেন ও তালেবানদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সামরিক অভিযানের হেতুও ছিল এটাই।
বহু হাজার তালেবান ও আল কায়দা সমর্থক আফগান শরণার্থী হয়ে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অনেকেরই আবার সে এলাকার বিভিন্ন উপজাতির সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সে সুবাদে তালেবান ও আল কায়দার সমর্থন পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে পাকিস্তানে যখন কলহ ও দলাদলিতে দুর্বল রাজনীতিকরা ক্ষমতার মালিকানা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোন্দলে লিপ্ত, সে সুযোগে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হন। বলতে গেলে দেশের একটা বিরাট এলাকা ইসলামাবাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
তালেবান গেরিলারা প্রায়ই পাকিস্তানি আশ্রয় থেকে গিয়ে আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদার বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে এসেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওয়াশিংটনের চাপে প্রায়ই সে এলাকায় সামরিক অভিযান চালায়। অন্যদিকে দূর নিয়ন্ত্রিত পাইলটবিহীন ড্রোন বিমানের আক্রমণ চালিয়ে মার্কিনিরা প্রায়ই উপজাতীয় অঞ্চলে বহু নিরীহ মানুষকেও হত্যা করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা এবং মার্কিন ড্রোনের আক্রমণে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় ৪৯ হাজার পাকিস্তানি মারা গেছে। পাকিস্তানের বহু প্রতিবাদের পর ড্রোন আক্রমণ সময়িকভাবে বন্ধ আছে শুনেছি।

আগ্রহ পাকিস্তানেরই বেশি
তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় পাকিস্তান সরকারেরই আগ্রহ বেশি মনে হচ্ছে। মহানগরী করাচির নিয়ন্ত্রণ অনেক দিন আগেই আলতাফ হোসেনের মোহাজের দলের হাতে চলে গেছে। তারা এখন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ারও দাবি তুলছে। সিন্ধে রাজনৈতিক অসন্তোষ টগবগ করে ফুটছে। দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রভাব বাড়তির দিকে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পাকিস্তান খান খান হয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে।
তালেবানদের স্বার্থের এখন মোড় ঘুরেছে। ব্রিটিশরা আফগানিস্তান ছেড়ে এসেছে। মার্কিনিরাও ছেড়ে যাবে চলতি বছরে। ১২ বছরের যুদ্ধে তাদের কোনো বাস্তব ফললাভ হয়নি। বহু নিরীহ আফগানকে তারা খুন করেছে। উল্টো মারও তারা কম খায়নি। হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার তাদের গচ্চায় গেছে ইরাক ও আফগান যুদ্ধে। তালেবানরা এখন দিন গুনছে। মার্কিনিরা সরে গেলেই তারা বিজয়গর্বে ফিরে যাবে আফগানিস্তানে। চাই কি কাবুলের মসনদও আবার তাদের হাতে আসতে পারে।
আলোচনায় বসতে তালেবান ও ইসলামাবাদ সরকারের সম্মতির এই হচ্ছে পটভূমি। বারো বছরের যুদ্ধে ক্লান্ত শক্তিধর পাকিস্তানি বাহিনীও বুঝে গেছে, অস্ত্রবলে তারা তালেবানদের পরাস্ত করতে পারবে না। তালেবানদের আগ্রহ ফিঁকে হয়ে যাওয়ার কারণ তো বললামই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নওয়াজ শরীফের সরকার বিজ্ঞতা সহকারে ইসলামপন্থী দলগুলোকে গণতন্ত্র ও সংবিধানের পথে আনতে, অথবা তাদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে পারে কিনা। এর মধ্যে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিহিত আছে। এক হিসেবে বলতে গেলে বিশ্বের মানুষ এখন বিপ্লবী হয়ে গেছে। গায়ের জোরের কথা তারা আর শুনতে রাজি নয়।
সে শিক্ষা একে-দুয়ে বিশ্বনেতাদের মস্তিষ্কেও ঢুকতে শুরু করেছে। কয়েক মাস আগে মনে হচ্ছিল পারমাণবিক বোমা তৈরির ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করবে এবং আরেকটা আঞ্চলিক মহাযুদ্ধ ঘটে গেলে ওয়াশিংটনের মগজের আমানতধারী ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে তার আধিপত্য আরও বিস্তার করে ফেলবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মনে শুভবুদ্ধির উদ্রেক হয়েছিল। আলোচনার মাধ্যমে তিনি সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেছেন মনে হয়। ভয়ানক গোসসা করেছে ইসরাইল, কিন্তু বিশ্বের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
গোটা মধ্যপ্রাচ্যের তলদেশে আরেকটা জ্বলন্ত বোমা সিরিয়া। বাশার আল আসাদ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, তিনি তার বাপের সম্পত্তির দখল ছাড়বেন না। তিন বছরের যুদ্ধে সিরিয়া দেশটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা গেছে এ যাবত। দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছে সাত মিলিয়ন (৭০ লাখ) সিরীয়। অধিকাংশই নারী ও শিশু। অনিশ্চিত পদক্ষেপে হলেও সিরিয়া সরকার এখন নিজেদের সঙ্গীন অবস্থা বিবেচনা করে এবং বিশ্ব সমাজের চাপে জেনেভায় বিরোধী দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে।

এ নির্বাচন মোটেই নির্বাচন নয়
মাত্র কয়েকটা দৃষ্টান্তই দেয়া হলো। বিশ্ববাসী এখন বুঝে গেছে, গায়ের জোরে গদি দখল করে থাকার দিন এখন বিগত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যারা জনগণের ভোট ছাড়াই গদি দখল করে আছেন, আর স্কুলের দুর্বিনীত ফাজিল ছেলেদের মতো বিরোধীদের প্রতি কুরুচিপূর্ণ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বর্ষণ করে যাচ্ছেন, সর্বনাশের অতল গহ্বর দেখতে তাদের এখনও বিলম্ব হচ্ছে। বিশেষ করে ভারত সরকারের ওকালতির সাহায্যে তারা বিশ্ব সমাজকে ভাঁওতা দিচ্ছিলেন এই বলে যে, সংবিধানের শর্ত পালনের জন্য রীতি রক্ষার্থে হলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হওয়া দরকার। নির্ধারিত ভোটের তারিখের আগেই বিনা ভোটে নিজেদের গরিষ্ঠ সংখ্যক আসনে নির্বাচিত ঘোষণা করে সে যুক্তি তারা নিজেরাই খণ্ডন করে দিয়েছেন।
জানুয়ারির ৫ তারিখে প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো নির্বাচনই হয়নি। দেশের কোথাও মানুষ ভোট দিতে আসেনি। অবশিষ্ট ১৪৭ আসনের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। সেখানেও শতাধিক ভোট কেন্দ্র আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। সাড়ে ছয় শতাধিক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয়া হয়। বহু ভিডিও ছবিতে দেখেছি, নির্বাচন কেন্দ্রগুলো ফাঁকা মাঠের মতো খা-খা করছে। ভেতরে কর্মকর্তারা ঘুমোচ্ছেন কিংবা হাতের নখ খুটছেন। বহু কেন্দ্র থেকে খবর এসেছিল যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা সারা দিন ধরে ব্যালটে ছাপ মেরে বাক্স বোঝাই করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণযোগ্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য হবে না ধরে নিয়ে বিশ্ব সমাজ পর্যবেক্ষক পাঠাতে অস্বীকার করেছে। কার্যক্ষেত্রেও সেটাই তারা দেখেছে এবং বলেছে। শুধু শেখ হাসিনার অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক দিল্লির সরকার ছাড়া।

মাঘ মাস কি আর আসবে না?
ভারতের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপে বিশ্ব সমাজ তাত্ক্ষণিকভাবে সে নির্বাচন বাতিলের দাবি করেনি। বরং কূটনৈতিক ভাষাতেই তারা যথাশিগগির সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য একটা নির্বাচন করার তাগিদ দিয়েছে শেখ হাসিনাকে। হাসিনা এবং তার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ কাঁচমাচু করে আমতা-আমতা করেছেন এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন শর্তের কথা বলেছেন। মনে হচ্ছিল যে ধানাই-পানাই করে হলেও বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সদুপদেশ তারা মেনে নেবেন।
মনে হচ্ছে তারা এখন ভাবতে শুরু করেছেন, এবারের মাঘ মাস যখন কেটে গেছে তখন আর শীতের ভয় করার প্রয়োজন নেই। ৫ জানুয়ারির পর থেকে একাত্তরের চাইতেও সাংঘাতিক গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে সরকার। সত্তরের দশকের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থী বিদ্রোহের সময় কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সরকার ‘গামছা-কিলিংয়ের’ পথ ধরেছিল। রোজই সকালে প্রদেশের এখানে সেখানে গলায় গামচার ফাঁস দেয়া নকশালপন্থীদের লাশ পথের ধারে কিংবা খোলা মাঠে পড়ে থাকতে দেখা যেত। কিন্তু কি লাভ হয়েছে কংগ্রেসের? ৩৭ বছর তারা পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা হাতে পায়নি। বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে সে রকম লাশের মিছিল। রাজনৈতিক পন্থায় সরকার বিরোধীদের মোকাবিলা করতে পারছে না। কারাগারগুলোতেও আর রাজবন্দিদের ধারণের স্থান নেই। এখন শুরু হয়েছে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং নিছক গ্রেফতার কিংবা গুম করে মাথায় গুলি করে হত্যার প্রক্রিয়া।
একথা এখন সবাই জানেন ও বিশ্বাস করেন যে, দলীয়কৃত পুলিশ ও র্যাব সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রাইভেট আর্মি ছাড়া কিছুই নয়। সরকার এতদিন ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে অক্সিলিয়ারি পুলিশ বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করছিল। সরকার ও শাসক দলের অনুকরণে তারা এখন স্বাধীনভাবে লুণ্ঠন, টেন্ডার-চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও হত্যার তাণ্ডবে মেতেছে। আওয়ামী লীগের নেতারা এবং মন্ত্রীরাও নাকি এখন শঙ্কিত। ছাত্রলীগ আর যুবলীগকে তারা আর সামালে রাখতে পারছেন না। বোতলের দৈত্য আর বোতলে ঢুকতে রাজি নয়। শুনছি প্রধানমন্ত্রী তাদের পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করে নিয়ন্ত্রণে আনার কথা ভাবছেন। সেজন্য নাকি আরও ৫০ হাজার পুলিশ নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এরশাদ হাসিনার জিউল মাছ?
এই হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলাহীনতার কিছু কিছু খণ্ডচিত্র। বিচার বিভাগে নৈরাজ্যের কথাও কারও অজানা নয়। সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা। প্রায় ছয় বছর র’য়ের হেফাজতে দিল্লিতে আশ্রিত থাকার পর শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে দেশে ফিরে আসেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। তার কিছুকাল আগেই জেনারেল এরশাদ ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন। তার মাত্র ১৩ দিন পর ৩০ মে রাতে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রে রাষ্ট্রপতি জিয়া শহীদ হন। পুলিশ চট্টগ্রাম এলাকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কিছু লোক তাকে ছিনিয়ে পতেঙ্গা সেনানিবাসে নিয়ে আসে। সেখানে রাতের বেলাতেই মাথার পেছনে একটিমাত্র গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়—খুব সম্ভবতই জিয়া হত্যায় আরও কোনো রাঘব বোয়াল জড়িত ছিলেন কিনা চাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে।
জিয়া হত্যা মামলার অন্যতম ও প্রধান আসামি জেনারেল এইচএম এরশাদ। এ মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার কথা ছিল গত সোমবার ১০ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তার কয়দিন আগেই একজন বিচারককে বদলি করা হয়। এবার আবার নতুন করে মামলার শুনানি হবে। উল্লেখ্য, একই টেকনিকে অতীতেও বহুবার এ মামলার রায়দান পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল।
ছোটবেলা গ্রামের বাড়িতে দেখতাম বিরাট মাটির জালায় পানিতে মাগুর মাছ জিইয়ে রাখা হতো প্রয়োজন মতো তুলে রান্না করার জন্য। আমার মনে হয়, হত্যা মামলা ঝুলিয়ে রেখে জেনারেল এরশাদকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ‘জিইয়ে’ রাখা হচ্ছে। তিনি যাতে কোনোমতেই বিরোধিতা করে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক খেলা বানচাল করে না দিতে পারেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জেনারেল এরশাদ ঘোষণা করেছিলেন, তার দল ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেবে না। তার পরিণতি কী হয়েছিল কাউকে মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে কি? ইসরাইলি কমান্ডো স্টাইলে এরশাদকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সামরিক হাসপাতালে ‘অসুস্থ’ রাখা হয়, যদিও তাকে গলফ খেলার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
সে অবসরে জাতীয় পার্টিকে ভেঙে খান খান করে ফেলা হয়, এরশাদের বৈধ এবং অবৈধ বহু স্ত্রীর মধ্যে প্রথমা রওশন পার্টির নতুন নেত্রী এবং সার্কাসের সংসদে সঙের মতো গৃহপালিত বিরোধী দলের নেত্রী হয়েছেন। শেখ হাসিনাকে আমোদিত করা ছাড়া তার আর অন্য কোনো ভূমিকার কথা কেউ ভাবতে পারেন না। জাতীয় পার্টির কোন টুকরোর কে নেতা, সেটা এখন রীতিমত গবেষণার বিষয়। তবে আমি ধরে নিয়েছি, শেখ হাসিনা যতদিন ক্ষমতায় আছেন ততদিন মঞ্জুর হত্যার রায় দেয়া হবে না। কারণ এই যে এরশাদ এবং হাসিনা পরস্পরের এত বেশি গুপ্ত খবর জানেন যে, সেসব ফাঁস হওয়া দু’জনের কারও জন্যই নিরাপদ হবে না।

লাশের মিছিলে কার কী লাভ হবে
লাশের মিছিলের কথা বলছিলাম। তাদের খুন করছে সরকার পক্ষের লোকেরা, কিন্তু সরকারি গোয়েবলসরা দায় চাপাচ্ছেন বিরোধীদের ওপর। হিন্দুদের নির্যাতন করছে, তাদের ঘরবাড়ি-দোকান-মন্দির পোড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা। হিন্দু নেতারাই বলছেন সে কথা। কিন্তু সরকার দোষারোপ করছে জামায়াত আর বিএনপির ওপর। বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হচ্ছে বলে গুজব শুনলেও ভারতের অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়। হাসিনা ও তার সরকার আশা করছেন তিনি ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ দলন করছেন শুনলে পশ্চিমা স্থূলমতিরাও খুশি হবে। এই সরকারের কোথাও এটা বোঝার মতো মাথার ঘিলু নেই যে এসব অপকাণ্ড এবং অপপ্রচার করে তারা একাধারে বাংলাদেশ, এ দেশের মানুষ এবং ইসলামের বিরুদ্ধেও কুত্সা ছড়াচ্ছে।
এসব করে কী লাভ হবে বলে আশা করছে তারা? পশ্চিম গোলার্ধে ক্রমেই বেশি সংখ্যায় মানুষ ধর্মান্তরিত হচ্ছে, ইসলামকে আলিঙ্গন করছে। বাংলাদেশে সবাই হেফাজতে ইসলাম হয়ে যাচ্ছে। কী লাভ হবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে? রোমের সম্রাটরা একদা যিশু খ্রিস্টের অনুসারীদের হিংস্র সিংহের সামনে ঠেলে দিয়েছেন, বহুদিন এই নতুন ধর্মকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। নিষিদ্ধ হলে জামায়াত ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যাবে। শতগুণ ভয়াবহতা নিয়ে তারা বংশানুক্রমিক আওয়ামীপন্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বারাক ওবামা, সিরিয়ার বাশার আল আসাদ কিংবা পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফের কাছ থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন।
কিন্তু তার সুমতি ও শুভবুদ্ধির উদ্রেক হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যেক জিম্মি করে রাখা যাবে না। বিশ্ব সমাজও সেটাই মনে করছে। মাসাধিক কাল ভারতীয় কূটনীতিকরা হাসিনার হয়ে দেশে দেশে ওকালতি করছেন। এক ডজন ডিগ্রি ক্রয়ের মতো করে অভিনন্দন ক্রয় করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু বিদেশিরা তাদের গড়িমসিতে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। অনেকগুলো দেশের রাষ্ট্রদূতরা আবারও তাড়া দিচ্ছেন শেখ হাসিনাকে; অবিলম্বে সংলাপে বসুন, যথাসত্বর একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার উপায় নিরূপণ করুন। শেখ হাসিনা যদি নিজের এবং বাংলাদেশর সর্বনাশ এড়াতে চান তাহলে এই শেষ মুহূর্তে এসেও শুভবুদ্ধির ডাকে সাড়া দিতে পারেন। তা না হলে কী যে ঘটতে পারে, ভাবতেও আমরা শিউরে উঠছি।

পূর্ব প্রকাশিত: আমারদেশ

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *