দেশটাকে লণ্ডভণ্ড করে দেবেন না, এবারে ক্ষান্ত দিন

কয়েক দিন ছুটি কাটাতে জার্মানিতে গিয়েছিলাম। ছুটিতে ল্যাপটপ কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া এ বয়সে আর সম্ভব নয়। ইন্টারনেটে নিয়মিত বাংলাদেশের খবর পড়ার সুযোগ ছিল না। জার্মানির মিডিয়া থেকে আজকের বাংলাদেশ সম্বন্ধে কোনো ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। স্টুটগার্টে এক জার্মান মহিলা চা খেতে ডেকেছিলেন। মহিলা এক জার্মান কোম্পানিতে চাকরি করেন। সেই সুবাদে মাঝে মধ্যে তাকে ভারতে যেতে হয়। সীমিত কিছু হিন্দি বলতে পারেন। বলেছিলেন, আমাদের তিনি ভারতের ব্র“কবন্ড চা খাওয়াবেন। আমাদের জন্য সুস্বাদু একটা কেকও তৈরি করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সঙ্কটের খবর শুনে বললেন, আশ্চর্য! জার্মান মিডিয়াতে তো এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার লেশমাত্র পাই না। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সম্বন্ধে একমাত্র রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির খবরই তিনি জানেন। তাও অসম্পূর্ণ। জার্মানিতে কয়েক হাজার বাংলাদেশী আছেন। তাদের নানা কর্মকাণ্ডের খবর প্রায়ই বাংলা পত্রিকায় পড়ি। তাদের তৎপরতা নিজেদের মধ্যে। নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত যে মূল ধারার জার্মান মিডিয়ার সাথে যোগাযোগের কথা তাদের মাথায় আসে না। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বরাবরই মিডিয়া সম্বন্ধে এবং মিডিয়াকে ব্যবহারের আর্ট সম্বন্ধে অজ্ঞ বলতেই হবে। একই দুর্বলতায় ভুগছেন বিএনপির প্রবাসী সমর্থকেরাও। খুবই দুর্ভাগ্যের কথা। লোকপরম্পরায় হলেও জার্মানিতে বসে বাংলাদেশের কিছু খবর পেয়েছি। খবরগুলো এ রকম : এক : জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুন সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন পদ্ধতি সম্বন্ধে সমঝোতায় আসতে অনুরোধ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে টেলিফোনে দীর্ঘ ব্যর্থ আলাপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে অনুকূল কোনো সাড়া মেলেনি। দুই : অনুরূপ অনুরোধ নিয়ে বিদেশী রাষ্ট্রদূত ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে বৈঠক করেছেন। কিন্তু ইসি তাদের কোনো ধরনের আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিন : বাংলাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং সারা বিশ্বে সম্মানিত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতেই নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে বিপাকে পড়েছেন এবং চার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসংখ্যবারের মতো আরো একবার জেদ ধরেছেন যে, সংবিধান অনুযায়ী (অর্থাৎ তার অধীনে) ছাড়া নির্বাচন হবে না এবং বর্তমান সংসদ বজায় রেখেই নির্বাচন হবে।

বাংলাদেশের মূল সংবিধানের রচয়িতা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের এক কালের আইন উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেনও বলেছেন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হচ্ছে সব নষ্টের মূল; বর্তমান সঙ্কটের জন্য পঞ্চদশ সংশোধনী হচ্ছে প্রকৃত দায়ী। পঞ্চদশ সংশোধনী কিভাবে পাস হয়েছে বাংলাদেশে কারো অজানা নয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারত-মার্কিন-আওয়ামী লীগ ত্রিমুখী ষড়যন্ত্রের যে মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচন হয় তাতে কার্যত একটা একদলীয় সংসদই সৃষ্টি করা হয়েছে। এমনই সুকৌশলে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল যে, বিএনপি মোট প্রদত্ত ভোটের ৩০ শতাংশ (অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম) ভোট পেয়েছে, কিন্তু তাদের আসন দেয়া হয়েছে সংসদে মোট আসনের দশ ভাগের এক ভাগের মতো। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিরোধী দলের নেতা এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এমন অশ্লীল গালিগালাজ শুরু করেন যে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ বিরোধী দলবিহীন সংসদে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালী সংশোধনের মতো করে বিনা আলোচনায় পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। সংবিধান নিয়ে ছেলেখেলা আমার স্কুলজীবনের শেষের দুই বছর (১৯৪৬-৪৭) কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগেই থাকত। আমি একটা বেসরকারি হিন্দু স্কুলে পড়তাম। স্বভাবতই আমার হিন্দু বন্ধু অনেক ছিলেন। কত দিন আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিয়ে থাকা যায়? আরো অনেকের মতো আমিও একটা ধুতি কিনেছিলাম। হিন্দুপাড়ায় যেতে কোচা দিয়েই ধুতি পরতাম, আর মুসলমান পাড়ায় কোচা খুলে পেঁচিয়ে লুঙ্গির মতো পরতাম সেই ধুতি। সংবিধান পবিত্র দলিল, জাতির অস্তিত্বের সনদ। কিন্তু শেখ হাসিনা সংবিধানকে ব্যবহার করেন নিছক ধুতির মতো সাময়িক সুবিধার উপকরণ হিসেবে। ১৯৯৬ সালে তিনি মনে করেছিলেন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি চালু হলে তাদের নির্বাচনী বিজয়ে সুবিধা হবে। তিনি জামায়াতে ইসলামের সাথে জোট বেঁধে আন্দোলন করেছিলেন, অনেক মানুষ খুন হয়েছিল, দেশ অচল করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ২০০৬ সালে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতেও তিনি জয়ী হতে পারবেন না। লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন করে দেশ অচল করে দেয়া হয়, প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে রাজপথেই অনেক মানুষ খুন করা হয়, শেষতক একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করে বর্ণচোরা সেনাশাসন ডেকে আনা হয়। মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনে দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বুঝে গেলেন যে তার নিজের অধীনে ষোলআনা দুর্নীতির নির্বাচন ছাড়া তার আর আওয়ামী লীগের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয় সে উপলব্ধি অনুযায়ী। এ সংশোধনী পাস করার হাতিয়ার হিসেবে সরকার ব্যবহার করেছে আদালতের একজন বিদায়ী প্রধান বিচারপতির একটি বিতর্কিত রায়কে, যে রায়েও বলা হয়েছিল যে রাজনীতির বাস্তবতা বিবেচনা করে পরবর্তী দু’টি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ সরকার এই বিতর্কিত রায়েরও মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করেছে, অন্য অর্ধেককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এই সংশোধনীতে শেখ হাসিনা শুধু একটা কথাই লিখতে বাকি রেখেছেন; সেটা এই যে তাকে গদি ছেড়ে দিতে বলা যাবে না, আজীবন তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন। এই আধাখেঁচড়া সংশোধনী অন্ধভাবে আঁকড়ে থেকে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন যে মুখে গণতন্ত্রের ধুয়া তুললেও আসলে তিনি নিকৃষ্ট স্বৈরতন্ত্রী, গণতন্ত্রকে হত্যা করে গদি আঁকড়ে থাকাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য।

ইউনূস মুখ খুললেই কেন আঁতে ঘা লাগে তত্ত্বাবধায়ক অথবা ভিন্ন কোনো নামে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন হওয়া উচিতÑ এটা বাংলাদেশের প্রায় সব বুদ্ধিমান মানুষেরই মনের কথা। মুখফুটেও বলেছেন অনেকে। ড. ইউনূস সে একই কথা বললে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বেশির ভাগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নিরেট মস্তিষ্ক নেতারা সহুঙ্কারে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছেন। জার্মানিতে বসে একটা উপমা আমার মনে হয়েছে। পাঁচ-ছয় বছর আগ পর্যন্তও ব্রিটেনে হাউন্ড (এক প্রজাতির হিংস্র শিকারি কুকুর) নিয়ে শিয়াল শিকার বৈধ ছিল। লাল কোট আর কালো হ্যাট পরা ডজনখানেক ঘোড়সওয়ার শিকারি একপাল হাউন্ড নিয়ে পল্লী ইংল্যান্ডে শিকারে বেরোতেন। শিয়াল দেখা গেলে (কখনো কখনো খাঁচায় বন্দী শিয়াল ছেড়ে দিয়ে) তারা হাউন্ডগুলোকে তার দিকে লেলিয়ে দিতেন। চল্লিশ-পঞ্চাশটা কুকুর মুহূর্তের মধ্যেই শিয়ালটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারি আক্রমণও হয়েছে সে গোছের। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুচরদের এই বিশেষ ‘অনুগ্রহের’ বিশেষ কারণ আছে। আগেরবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের নাম না জানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডজনখানেক অনারারি ডক্টরেট যোগাড় করেন। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি দৃষ্টি আরো ঊর্ধ্বমুখী করলেন। তিনি স্থির করলেন যে তার একটা নোবেল পুরস্কার চাই। রাষ্ট্রের ব্যয়ে রাষ্ট্রের কূটনীতিক ও আমলাদের তদবির করার জন্য দেশ-বিদেশে পাঠানো হলো। তারা সবাই ফিরে এলেন শূন্য হাতে। অন্য দিকে নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কার দিলো মুহাম্মদ ইউনূসকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীরা থেকে শুরু করে সব মহাদেশের শক্তিধর ও মানীগুণী ব্যক্তিরা তাকে অভিনন্দিত করলেন। সব বাংলাদেশীরও উচিত ছিল তার জন্য গৌরব বোধ করা। কিন্তু এ দেশের প্রধানমন্ত্রী করলেন ঠিক উল্টোটা। শিক্ষক কাসের ভালো ছাত্রছাত্রীদের বেশি স্নেহ করলে ঈর্ষাতুর রদ্দি ছাত্রছাত্রীরা যেমন জ্বলেপুড়ে মরে, শেখ হাসিনার হয়েছে সেই অবস্থা। যেকোনো ভাবে পারা যায় ইউনূস ও তার গুণগ্রাহীদের হয়রানি ও হেনস্তা করা এ সরকারের ও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রধান করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তারা এতই স্বল্পবুদ্ধির যে, যতবার তারা ইউনূসকে ছোট করতে চাইছেন ততবার তারাই যে ুদ্র থেকে ুদ্রতর প্রমাণিত হচ্ছেন, সেটাও তারা বুঝে উঠতে পারেন না। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনের কথায় শেখ হাসিনা কান দেবেন কেমন করে? বাংলাদেশের তথ্যাভিজ্ঞ ও সুশীলসমাজের সবাই বলছেন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সংসদে ২০ থেকে ৫০টির বেশি আসন পাবে না। সংখ্যাটা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি কার কতখানি সহানুভূতি তার ওপর। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তিনি ও তার দল যে হেরে নাস্তানাবুদ হয়ে যাবেন শেখ হাসিনা নিজেও সেটা বোঝেন। নিজের কবর নিজে তিনি খোঁড়েন কী করে? নইলে কিছুকাল আগে বান কি মুনের সহকারী যখন সশরীরে ঢাকায় এসে তিন-চার দিন কাটিয়ে গেলেন তখনই সরকার নির্বাচন পদ্ধতি সম্বন্ধে বিরোধীদের সাথে সংলাপে বসতে পারত। মুখে এরা বলেও ছিল যে তারা সংলাপে বসবে, সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে চিঠি লিখবে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিবের বিমান নিউ ইয়র্কে নামার আগেই সরকার তাদের প্রতিশ্র“তি গিলে খেল।

আওয়ামী লীগের মহাসচিব সৈয়দ আশরাফ ও অন্য মন্ত্রীদের সুর বদলে গেল। তারা বলতে শুরু করলেন, কিসের সংলাপ? কার সাথে সংলাপ? অথচ বিএনপি বর্তমান সঙ্কটের শুরু থেকেই বলে এসেছে যে অশান্তি ও হানাহানি এড়ানোর লক্ষ্যে এরা যেকোনো সময় সংলাপে বসতে রাজি আছে। বান কি মুন এবং তার আগে তার সহকারীকেও সে কথা বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে। এখন আবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সংলাপে বসার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়াকে চিঠি লিখেছেন। খালেদা জিয়া তো আগে থাকতেই রাজি হয়ে আছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি হবেন কি না সন্দেহ। ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। বেচারা নির্বাচন কমিশন! সরকারের পরিকল্পনা (কিংবা ষড়যন্ত্র) কার্যকর করার জন্য তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। কশিনারদের হাত-পা বাঁধা গণভবনের কাছে। সেখান থেকে যে নির্দেশ আসে তার বাইরে কিছু করার শক্তি তাদের নেই। বিদেশী রাষ্ট্রদূত আর দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের অনুরোধ রক্ষা করার কিংবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্র“তি দেয়ার সাধ্য তাদের কোথায়? তারা তো আর ব্রিটেন কিংবা ইউরোপের কোনো দেশের মতো স্বাধীন ও সার্বভৌম নির্বাচন কমিশন নন! ঢাকায় বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূত আছেন। বাংলাদেশে কী হচ্ছে আর কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এরা সব সময়ই নিজ নিজ দেশের সরকারকে জানিয়ে রাখেন।

ইউনূস প্রসঙ্গ, পোশাকশ্রমিকদের প্রতি অমানুষিক আচরণ, ইসলামপন্থীদের নিষ্পেষণ, শাপলা চত্বরের গণহত্যা, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ইত্যাদি বহু ব্যাপারে প্রায় সব দেশের সাথে এ সরকারের সম্পর্ক সর্বনিম্নে (ভারতীয় সাংবাদিকদের ভাষায় তলানি ছুঁয়ে গেছে)। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যে আপাতঃদৃষ্টিতে সেটা গ্রাহ্য করছেন না এর কারণ মাত্র একটা বিদেশী খুঁটির ওপর তিনি ঈমান এনেছেন, সে শক্তির ওপর তার অপরিসীম ভরসা। বাংলাদেশকে আরেকটা সিকিম করার অভিপ্রায়ে ভারত ২০০৬-২০০৮ সালে মার্কিন প্রশাসন ও ছয় ঘোড়া উপহার পাওয়া সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের সাথে ষড়যন্ত্র করে এ সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে। ভারতকে তিনি কী দিলেন আর কী পেলেন না হাসিনা আশা করছেন, ভারতকে সব কিছু দিতে তার আরো কিছু বাকি আছে। সুতরাং ভারত কিছুতেই মাঝপথে তাকে রিক্ত হাতে বিদায় করবে না। বাংলাদেশের সীমান্তে অনুপ্রবেশ অথবা ফেলানী হত্যার মতো অমানুষিকতা বিডিআর কখনোই সহ্য করেনি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ৫০ দিনের মধ্যেই অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে বিডিআর বিদ্রোহ হলো, ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হলেন, হত্যালীলার মাঝপথে বিদ্রোহীরা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘ আলাপ করল, সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে আসছিল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মাঝপথে তাদের থামিয়ে দিলেন, অকস্মাৎ মাথায় রুমাল বাঁধা কিছু অপরিচিত লোকের আবির্ভাব হলো পিলখানায় এবং হঠাৎ করেই আবার তারা হাওয়া হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের পুরোধা বিডিআর বাহিনীর নাম পাল্টে দেয়া হলো, শত শত বিডিআর জওয়ানকে শাস্তি দেয়া হলো, কয়েদখানায় মারা গেলেন অনেকে, কিন্তু বিদ্রোহের কারণ ও দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য কোনো তদন্ত হলো না। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ বেদম মার খাবে, শেখ হাসিনা আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন নাÑ এই ধ্রুব সত্য নিয়ে ভারতের মিডিয়া ইতোমধ্যেই মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে। তারা যে দিল্লির সরকারের হৃৎপিণ্ডের তড়পানির প্রতিধ্বনি করছে সেটাও জানা কথা। সত্য বটে শেখ হাসিনা দুই ধারায় এশিয়ান হাইওয়েকে ভারত থেকে আবার ভারতে নিয়ে শেষ করতে রাজি হয়েছেন।

সত্য বটে রেল, সড়ক ও নদীপথে ভারতের মূল অংশ থেকে উত্তর-পূর্বের সাতটি অঙ্গরাজ্যে যাওয়ার করিডোর এবং বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর দু’টিকে অবাধে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এবং ভারত এসবই পাচ্ছে বিনা ব্যয়ে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার মতে, ভারতের কাছ থেকে টাকা নেয়া অসভ্যতা হবে। কিন্তু ভারত এখনো আতঙ্কমুক্ত হতে পারছে না। ভারতীয়রা জানে বিনিময়ে তারা বাংলাদেশকে কিছুই দিতে পারেনি এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভারতবিরোধী। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালেই বেরুবাড়ী ছিটমহলটি ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বিনিময়ে ভারত নানা বাহানায় তিনবিঘা ছিটমহলটি বাংলাদেশকে দিতে অস্বীকার করে আসছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা এসেছিলেন, বাংলাদেশের সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। কিন্তু সে চুক্তি আজ অবধি স্বাক্ষরিত হয়নি। ইতোমধ্যে ৫৩টি অভিন্ন নদীতে ভারত কয়েক শ’ বাঁধ তৈরি করেছে, টিপাইমুখে বাঁধ তৈরি করে সুরমা ও কুশিয়ারা, অতএব মেঘনা নদীও শুকিয়ে মারার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। দিল্লির সরকার জানে নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন। শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারি দিল্লিতে গিয়ে যেসব গোপন চুক্তি করে এসেছিলেন সেগুলো সংসদে পেশ করার জন্য দলের ও দেশের দাবি প্রতিরোধ করা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। শেখ হাসিনার উপহার করিডোর ভোগ করা সে ক্ষেত্রে ভারতের ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। শেখ হাসিনা আশা করছেন, আন্দোলন করে সরকার হটাতে বিএনপি ও ১৮ দল এতকাল ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনের আগের কয়েক মাসও তারা বিদেশী দূতাবাসগুলো এবং জাতিসঙ্ঘের চাপে বড় মাপের আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে। তিনি তার অতিপরিচিত কৌশলে বিভিন্ন বাহানা সৃষ্টি করে যদি কালক্ষেপণ করতে পারেন তাহলে শেষ মুহূর্তে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী একটা লোকদেখানো সাজানো-পাতানো নির্বাচন করে ঘোষণা দেবেন যে, আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। উন্মাদ গণপলায়ন বর্তমান সরকারের বিকল্প নীলনকশা হচ্ছে দেশে অরাজকতা দেখা দিয়েছে অজুহাত দেখিয়ে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন এবং বর্তমান সংসদই বহাল আছে বলে ঘোষণা দেবেন। নিশ্চয়ই এ লক্ষ্যেই তিনি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের সব সংবিধান বিশেষজ্ঞ তাতে বিস্মিত, স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজও বলেছেন যে আগে থেকে সংসদ ভেঙে না দিলে নির্বাচনে নানান জটিলতা দেখা দেবে। জার্মানি থেকে ফিরে এসে খবর পেলাম কুয়ালালামপুর, দুবাই ও লন্ডনে বাড়ি ও ফ্যাট কিনেছেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। বিগত দু-তিন মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার আওয়ামী লীগার বিভিন্ন দেশের ভিসা নিয়েছেন। বিগত পৌনে পাঁচ বছরে দেশ থেকে যে বহু হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে সেগুলো এখন বিদেশে সম্পত্তি কেনার কাজে লাগছে। শেখ হাসিনার নীলনকশা যাই হোক আওয়ামী লীগারেরা বুঝে গেছেন গণজোয়ারের মুখে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, শেখ হাসিনার গদিও বেহাত হলো বলে। অতএব ‘সময় থাকতে দাদা হও সাবধান’। (লন্ডন, ১০.০৯.১৩) বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *