দুর্নীতি প্রতিরোধে বাধা কোথায়?

দুর্নীতি যেকোনো দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। আর এ কারণেই প্রতিটি দেশ দুর্নীতি নির্মূলে সচেষ্ট হলেও তা পুরোপুরি নির্মূলে সফল এরূপ দেশের সংখ্যা হাতেগোনা দুয়েকটি। বর্তমানে পৃথিবীতে উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে দুর্নীতি বেশি। এর পেছনে কারণ হলো গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি।
নীতিবিরুদ্ধ যেকোনো কাজ দুর্নীতি হলেও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ধারণা অন্যায়ভাবে বৈধ আয় বহির্ভূত যেকোনো ধরনের অর্থ উপার্জন দুর্নীতি। একজন পদস্থ বা ক্ষমতাধর ব্যক্তি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার কোন আত্মীয় বা কাছের মানুষকে চাকরিতে নিয়োগ দিলে সেটিও দুর্নীতি, যদিও তাতে অর্থের লেনদেন থাকে না। অনুরূপ জ্যেষ্ঠ, যোগ্য ও সৎকে অতিক্রান্ত করে রাজনৈতিক বা কোনো বিশেষ বিবেচনায় কনিষ্ঠ, অযোগ্য ও অসৎকে উচ্চ পদে আসীন করা হলে সেটিও দুর্নীতি। আবার জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও সাজানো বা পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয় হাসিল করাও দুর্নীতি। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী সরকারি সম্পদের অপব্যবহার করলে যেমন দুর্নীতি, একইভাবে দাফতরিক কাজ ফেলে রেখে গল্পগুজবের মাধ্যমে অফিস সময় পার করে দেয়াও দুর্নীতি। অনেক কর্মকর্তাকে দেখা যায়, অফিসের কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করে অর্থ উপার্জন করছেন এটিও দুর্নীতি।
সাধারণত যেকোনো দেশে যেকোনো ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অবলম্বনের মাধ্যমে নিয়োগকার্য সম্পন্ন করার কথা থাকলেও অনেক দেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতার কারণে তা হয়ে ওঠে না। অনেক দেশের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশ অন্যতম।
আমাদের দেশে বিভিন্ন বিভাগ বা দফতরের শীর্ষ বা উচ্চ পদে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অনেকে জ্যেষ্ঠ, দক্ষ, যোগ্য ও সৎ না হওয়া সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের শীর্ষ বা উচ্চপদে আসীন করানোতে দেখা যায় বিভাগ বা দফতরটির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং বিভাগটিতে নিয়মনীতি কিছুরই বালাই থাকে না। এরূপ বিভাগ বা দফতর যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্ট, এমন পরিস্থিতিতে বিভাগ বা দফতরটি সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে যে বিচ্যুত হবে বিভাগ বা দফতরটির সামগ্রিক কার্যাবলি পর্যবেক্ষণ এমনই ধারণা দেয়।
সাংবিধানিকভাবে আমাদের দেশটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের সংবিধানে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশ নেয়া নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের সংবিধানটি যে চেতনা ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত তা হলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন একটি শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত থাকবে।
আমাদের দেশে দু’ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং উভয় নির্বাচনেই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। উল্লিখিত দু’টি নির্বাচনের একটি হলো জাতীয় নির্বাচন এবং অপরটি স্থানীয় নির্বাচন। স্থানীয় নির্বাচনের আবার রকমফের রয়েছে যথাÑ সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ। বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী এযাবৎকাল পর্যন্ত জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ভিত্তিতে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। উপর্যুক্ত সব নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন বহন করে থাকে। আমাদের নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে যে ক্ষমতা দেয়া আছে, তাতে কমিশন আন্তরিক হলে যেকোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা সম্ভব। কিন্তু গোড়াতেই যদি গলদ থাকে সেক্ষেত্রে দেখা যায় নির্বাচন কমিশন নিজেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এক বাধা।
আমাদের দেশে এ পর্যন্ত দলীয় সকারের অধীন যেসব নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে এর প্রায় প্রতিটিই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় জনমতের প্রতিফলনের চেয়ে দলীয় সরকারের আকাক্সাকে প্রতিফলিত করে তাদের নির্বাচনে বিজয়ের পথকে সুগম করেছে। জনমতের প্রতিফলনের ব্যত্যয়ে নির্বাচন কমিশন দলীয় সরকারের আকাক্সা বাস্তবায়ন করলে তা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। দলীয় সরকারের নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় কাদের দিয়ে এ ধরনের নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ করা সম্ভব সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে দলীয় সরকার এমন আজ্ঞাবহ, অথর্ব, নির্বোধ, ভাবলেশহীন ও ব্যক্তিত্ববিবর্জিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠনে বদ্ধপরিকর থাকে। এ ধরনের কমিশন কখনো দলীয় সরকারকে নিরাশ করেছে, এমনটি দেখা যায়নি। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলার পরও যখন নির্বাচন কমিশন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে জনআকাক্সার বিপরীতে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে জনসমক্ষে উপস্থিত হয়, তখন তাদের এ ধরনের কার্যকলাপ দুর্নীতি বৈ অন্য কিছু নয়।
আমাদের দেশ বিগত শতকের ৯০ দশক পরবর্তী সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা দিয়ে শাসিত হয়ে আসছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় কী পদ্ধতিতে সংসদ গঠিত হবে, তা সুস্পষ্টরূপে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে। যদি কোন সংসদ নির্বাচনে দেখা যায় একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত আসনের অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তখন সে সংসদটি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী গঠিত হয়েছে এমন কথা বলার অবকাশ কতটুকু।
যেকোন সময় জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অস্বচ্ছ ও কলুষিত হলে, তা দেশের সচেতন জনগণের চোখে ধুলো দিতে পারে না। অস্বচ্ছ ও কলুষিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি যতই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন না কেন নির্বাচনের অস্বচ্ছতা ও কলুষতা যে তার ব্যক্তিত্বকে ম্লান করে দেয়, সে বিষয়টি এ দেশের জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। যেকোন সময় অস্বচ্ছ ও কলুষিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল বিজয় হাসিল করতে চাইলে তাকে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবৈধ ও অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। এ ধরনের অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। আর যেকোনো বিভাগ বা দফতরের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের ওপর বিভাগীয় বা দাফতরিক প্রধান বা পদস্থদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সে বিভাগ বা দফতর যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে জনসেবার পরিবর্তে জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়টি এ দেশের জনমানুষ ইতোমধ্যে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের দেশে একটি বহুলপ্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, ‘মাছের পচন মাথা হতে শুরু হয়’। মাথার পচন যে সমস্ত দেহকে সংক্রমিত করে তা সবারই জানা। অস্বচ্ছ ও কলুষিত নির্বাচনের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন অন্যায় ও অবৈধ কাজকে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে ঘটে। এ ধরনের অন্যায় ও অবৈধ কাজ দুর্নীতির সমার্থক। সুতরাং সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে অনিয়ম ও অন্যায় প্রতিবিধানে নিষ্ক্রিয়তা এগুলোর বিস্তারে উৎসাহ জোগায়।
আমাদের দেশে অতীতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতরে শীর্ষ ও উচ্চ পদসসমূহ পূরণের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা, সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতা এ চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হতো। বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে এ চারটি বিষয়ের জলাঞ্জলি দিয়ে জ্যেষ্ঠ, সৎ, দক্ষ ও যোগ্যদের অতিক্রান্ত করে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট, পক্ষপাতদুষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য, অসৎ ও কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অতিমূল্যায়িত করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের শীর্ষ ও উচ্চ পদে আসীন করানো হচ্ছে। এ কর্মকর্তাদের কিছু কিছু এমনই অযোগ্য ও অথর্ব যে তাদের অতি সাধারণ যেকোনো বিষয়ের ওপর বাংলা বা ইংরেজিতে পাঁচ লাইন লিখতে বলা হলে তারা তা শুদ্ধভাবে লিখতে অক্ষম। তা ছাড়া যেকোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে যখন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, দক্ষ, যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এ ধরনের কনিষ্ঠদের অধীন কাজ করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলেও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি দেখা দিবে এ বিষয়টি উপেক্ষা করার মতো নয়। সুতরাং যেকোনো দলীয় সরকারের জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া জ্যেষ্ঠদের অতিক্রান্ত ও অবমূল্যায়ন কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের সহায়ক নয়।
বাংলাদেশ একই ভাষাভাষীসদৃশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। জনসংখ্যার দিক থেকে এরূপ সদৃশ্যতাসম্পন্ন দেশ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ দেশের জনমানুষ যেমন অনুভূতিপ্রবণ ঠিক তেমন একের বিপদে অপরে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তা আমরা আমাদের বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগের সময় প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের যেকোনো দলীয় সরকারের উচিত দেশের সাধারণ জনমানুষের সমরূপতা, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততাকে কাজে লাগিয়ে এমন জাতি ও দেশ গঠনে প্রত্যয়ী হওয়া যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলনে প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হয় যা দেশের সবপর্যায় থেকে দুর্নীতি সম্পূর্ণ নির্মূল করতে না পারলেও অন্তত প্রতিরোধে অন্তরায়সমূহের অবসান ঘটাবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

পূর্ব প্রকাশিত: নয়া দিগন্ত

 

Loading

Comments are closed.