তুর্কীরা লোসান চুক্তি ভুলে নাই

ভূমিকা :
ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াতে তুরস্ক নিয়ে বেশ লেখালিখি শুরু হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার এক শ্রেণীর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইলিটদের কাছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান এখন খুবই অপছন্দের এক ব্যক্তিত্ব। তাই তাকে নিয়ে প্রায়ই নেতিবাচক খবর ও নিবন্ধ দেখা যায় পশ্চিমা মিডিয়াতে।

তুরস্কের পুরানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান যা করছেন সেটি যে তুরস্কের জাতীয় স্বার্থে জরুরি যা দেশের অধিকাংশ মানুষ সমর্থন করলেও আমেরিকা ও ইউরোপের অনেকের কাছে তা গ্রহনযোগ্য নয়। তুরস্ক ইউরোপ মহাদেশের একটি দেশ ও ন্যটোর সদস্য হলেও পশ্চিমা বিশ্বের মোড়লদের ইচ্ছা মাফিক চলার নীতি অনুসরণ না করায় প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ইচ্ছা পশ্চিমা রাজনৈতিক মহলে এখন অনেকটা “ওপেন সিক্রেট” ।

এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান আগামী ২৪ জুন নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ঘোষণা দেয়ায় অনেকে সমালোচনা করছেন। তারা এ নির্বাচন প্রেসিডেন্ট এরদোগানের “স্বৈরাচারী ক্ষমতা” দখলের অভিপ্রায় হিসাবে দেখছেন! এ ঘোষণার ফলে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় আগে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এরদোগান বলেন, দেশটির বিরোধী দল ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) প্রধান ডেভলেত বাচেলির প্রস্তাব অনুসারে আগাম নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। এ নির্বাচনের পর দেশটির শাসন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পাবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, পুরনো পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা ছিল দুর্বল। তবে আগামী নির্বাচনের পর সরকার ও প্রেসিডেন্ট একসঙ্গে কাজ করবে। তুরস্কের নির্বাচন এমন সময় ঘোষণা দিয়েছেন যখন এরদোগান সরকারের সফল আফরিন অভিযান শেষ হয়েছে। ওই অভিযানের পর পিকেকেসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য হামলার ঝুঁকি থেকে অনেকটা নিরাপদ হয়েছে। এছাড়াও তুরস্কের এককভাবে পরিচালিত এ অভিযান আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশটির গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি এরদোগানের জন্য আগামী নির্বাচনে বিশেষ সহায়ক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তুর্কীরা লোসান চুক্তি ভুলে নাই!

যারা ইতিহাস চর্চা করেন তাদের জানা আছে ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়ার পর তুরস্কের উপর যে একশ বছর মেয়াদি চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয় সেটি হচ্ছে “লোসান চুক্তি ” (Treaty of Lausanne) যা ২০২৩ সালে শেষ হবে। সে চুক্তির ফলে আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক মানচিত্র ছোট করতে তুরস্কের সীমানার অনেক অঞ্চলগুলিকে ছেড়ে দিতে তখন বাধ্য করা হয়। তাই তুর্কীরা তাদের দেশের ভৌগোলিক মানচিত্র হ্রাস করার সে স্মৃতি এবং “লাউসেন কনভেনশনের শর্তগূলো তুরস্কের জাতীয় অধিকার ও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন হিসাবে দেখে। অতএব সে চুক্তির কারণে ইচ্ছা করলেও ভূরাজনৈতিক কিংবা তাদের আর্থ সামাজিক অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তুরস্কের উপর যে বাধা ছিল তা থাকবেনা ২০২৩ সালের পরে ।
তুরস্ক তখন পশ্চিমা কর্তৃত্ব থেকে সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাবে সে প্রত্যাশা প্রকাশ পায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যে যখন বলেন,২০২৩ সালে তুরস্ক একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে।


Ferries cross the Bosporus in Istanbul. To reduce crowding, the government plans to build a massive new canal

তুরস্কের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হবে যেমন তেল অনুসন্ধান এবং জাহাজ চলাচলের উপযুগী একটি নতুন জলপথ বা চ্যানেল লিঙ্কিং তৈরি হচ্ছে “মারমারা” ও “ব্ল্যাক” সাগরের মধ্যে যা তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভুমিকা রাখবে। সে প্রজেক্ট প্রস্তুতির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।

এলাকার তিনটি সংযুক্ত প্রকল্পগুলির মধ্যে, সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী কানাল যা ইস্তাম্বুল কানাল নামে পরিচিত,। এটি একটি বিশাল নৌযান ট্র্যাফিকের রুট হবে যা বোস্টোরোস থেকে ১৮ মাইল (৩০ কিলোমিটার)। নতুন এ সব কানালের উভয় পাশে উচ্চমানের আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠবে।

 
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তুরস্কের জন্য তেল অনুসন্ধান করা এবং তেলের উৎপাদনকারী দেশগুলোর সাথে যোগদান করা সম্ভব হবে, পাশাপাশি বোতসোফরস স্ট্রেইটের মধ্য দিয়ে যাওয়া জাহাজগুলি থেকে ফি সংগ্রহ এবং খননকার্য কালো সাগর এবং মরমা সমুদ্রের সংযোগকারী একটি নতুন চ্যানেল,যা লাউসেন চুক্তির ভিত্তিতে তুরস্কে নিষিদ্ধ; জাহাজ চলাচলে ফি চালু করা ও সংগ্রহের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে ইত্যাদি পশ্চিমা শক্তিরা সহ্য করবে কিনা তা দেখার বিষয়।
তাই অনেকে মনে করেন কিছু ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির সাথে তুরস্কের বর্তমান রাজনৈতিক যে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে তার পিছনের অন্যতম কারণ চুক্তির মেয়াদ শেষে অর্থাৎ পশ্চিমা শক্তির কর্তৃত্ব হারালে কি ঘটতে পারে সে অন্চলে সে ভয় পশ্চিমা শক্তিকে তাড়া করছে! জার্মানী যেমন ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার চূক্তি মেয়াদ শেষে নিজেরমত চলতে চাচ্ছে, কিংবা চীনকে যেভাবে হংকং এ তাদের স্বার্বভৌমত্ব স্থাপন করতে দেয়া হয়েছে তেমনি যে সব অন্চলে তুরস্কের সার্বভৌমত্বকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল যেমন সাইপ্রাস, লিবিয়া,মিশর, সুদান, ইরাক ও লেভান্টক বিশেষকরে সিরিয়াতে যে শহরগুলো অবস্থিত ছিল,যেমন উরফা,আদানা ইত্যাদি অন্চলে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সম্পর্ক হারিয়েছিল সে সব দেশে হস্তক্ষেপের পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারে। বিশেষকরে তুরস্ক মোসুলের হস্তক্ষেপের পক্ষে যুক্তি উপলব্ধি করে,যা চার শতাব্দী ধরে তুরস্কের অন্তর্গত ছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে “লায়োসেন চুক্তি” মেয়াদ শেষে তুর্কিরা কি সে অঞ্চল মিলিয়ে একটি আধুনিক অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে ফিরে আসবে? তাদের ভৌগলিক মানচিত্র কি পরিবর্তন হতে যাচ্ছে? কিংবা সেই সাথে বিশ্বে অটোমান উত্তরাধিকার সংস্কারের কি একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করবে? এসব প্রশ্ন আসছে। তবে তুরস্ক সে পথে চলার আগেই শান্তির পরিবর্তে আর একটি বড় আকারের যুদ্ধ কি পশ্চিমাদের কাছে অপরিহার্য হয়ে পড়বে? আর সে জন্য ২০২৩ সালের আগেই তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে কিনা সে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অনেকের মনে।

আরব সাগরে তার দেশের যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, আবার পারস্য উপসাগরের তীরে রয়েছে তাদের ট্যাঙ্ক।বর্তমানে কাতার ও সোমালিয়ায় এবং সুদানে তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করা আছে। আবার ইয়েমেন ও সোমালিয়ার মধ্যবর্তী গাল্ফ অব এডেনে তুরস্কের নৌবাহিনীর জলযান টহল দিচ্ছে।
তুরস্কের সঙ্গে সোমালিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেকদিনের। তুরস্ক সেখানে ব্যাপক মানবিক সহায়তাসহ দেশটির মৌলিক অবকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করেছে।
তুরস্কের বৃহত্তর সমাজের বর্তমান মা্ইন্ড সেটের উপর একটি নিরপেক্ষ রিপোর্ট নিচের ভিডিওতে পাওয়া যায়।

Reference:
Can Turkey renovate its empire by the end of the Treaty of Lausanne 2023
তুরস্কের বিস্তার অটোমান সাম্রাজ্যের পুনর্জাগরণের লক্ষণ।

Comments are closed.