‘জঙ্গীবাদ’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ কি একই জিনিস?

অনেক সময় বিভিন্ন তাত্বিক লেখাজোখা ও আলোচনায় জঙ্গীবাদের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসের পাতা থেকে সন্ত্রাসের অনেক উদাহরণই তুলে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু আগে ভেবে দেখা দরকার যে, ‘জঙ্গীবাদ’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ একই জিনিস কিনা-

[জঙ্গী= [adjective] Military.

Military= সামরিক, জঙ্গী, সেনাবাহিনী, সশস্ত্রবাহিনী

Militarism= সুদৃঢ় সামরিক অবস্থা বা আয়োজন, সামরিক শক্তি ও তাদের সদগুণাবলীর উপর আস্থা ও নির্ভরশিলতা, সমরবাদ

জঙ্গীলাট= Commander-in-chief

সন্ত্রাসবাদ= Terrorism

সন্ত্রাসক/ সন্ত্রাসবাদী= Terrorist]

না, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ একই নয়। হুমকি বা সন্ত্রাসমূলক কাজের মাধ্যমে আতংক সৃষ্টি করা হলে তাকে টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ বলা যায়। কিন্তু তাই বলে কি সব ধরনের সামরিক/ জঙ্গী/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীর অভিজানকে ঢালাওভাবে টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ বলা ঠিক হবে? বরং সামরিক/ জঙ্গী/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীর অভিজানকে আদর্শগত বা তত্ত্বগতভাবে জঙ্গীবাদী তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করাই তো যুক্তিসঙ্গত এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর প্রয়োজন হতেই পারে।

যদি জঙ্গী মানেই সন্ত্রাসক/ সন্ত্রাসবাদী হয়, তাহলে তো সকল সামরিক/ জঙ্গী/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরাই সন্ত্রাসবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ও জনসাধারনের দুঃসময়ে পাশে থাকার মানবিক মহৎ উদ্দেশ্যেই সামরিক/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনী গঠন করা হয়ে থাকে। সামরিক শক্তি ও তাদের সদগুণাবলীর উপর আস্থা ও নির্ভরশিলতা হলো সমরবাদ বা জঙ্গীবাদ অর্থাৎ Militarism এর মূল বিষয়। সুতরাং জঙ্গী মানেই সন্ত্রাসক/ সন্ত্রাসবাদী নয়। বরং যে মতবাদ জঙ্গী অর্থাৎ সামরিক/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীকে সন্ত্রাসক কর্মকাণ্ডে লেলিয়ে দেয় তাকে সন্ত্রাসবাদ অর্থাৎ Terrorism বলা যেতে পারে।

সুতরাং—

*স্বাধীনতা, মানবতা,মানুষেরন্যায্যঅধিকার ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বা আদায়ের জন্য পরিচালিত যেকোন সামরিক/ জঙ্গী/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীর অভিজানকে জঙ্গী তৎপরতা অর্থাৎ Military actions বলা যেতে পারে এবং এর সাথে যারা জড়িত তাদেরকে যুদ্ধরত অর্থাৎ Militant বলাই যুক্তিযুক্ত হবে।

*অপরদিকে সমাজে শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অশান্তি সৃষ্টি এবং মানবতা, স্বাধীনতা ও মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণের জন্য পরিচালিত যে কোন সামরিক/ জঙ্গী/ সেনাবাহিনী/ সশস্ত্রবাহিনীর অভিজানকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অর্থাৎ Terrorist activity বলা যেতে পারে এবং এর সাথে জড়িতদেরকে সন্ত্রাসবাদী অর্থাৎ Terrorist বলাই যুক্তিযুক্ত হবে।

সুতরাং সকল প্রকার মানবিক অর্থাৎ Humanitarian Military actions হলো Militarism অর্থাৎ সমরবাদ বা জঙ্গীবাদ এর অন্তর্ভূক্ত এবং সকল প্রকার অমানবিক অর্থাৎ Inhuman Terrorist activity হলো Terrorism অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ এর অন্তর্ভূক্ত। 

উর্দু আর ফার্সিতে ‘জঙ্গ’ শব্দটির অর্থ ‘যুদ্ধ’। আর যারা জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ করেন তাদেরকে জঙ্গী অর্থাৎ যোদ্ধা/ যুদ্ধরত/ লড়াকু বলা হয়। সে অর্থে যেকোন ‘স্বাধীনতা যুদ্ধকে’ উর্দু বা ফার্সিতে ‘জঙ্গে আজাদি’ বলা হয়ে থাকে। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অন্যায় অত্যাচার আর জুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে এবং ন্যায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেন তাদেরকে সম্মানের চোখে দেখাটাই স্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাঙালীদের অধিকার রক্ষায় জীবন বাজি রেখে যারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেছিলেন তারা আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। তাদেরকে বাংলায় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলা হয় আর উর্দু ও ফার্সিতে তাদেরকে ‘জঙ্গীয়ে আজাদি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। সুতরাং জঙ্গী একটি সম্মানিত শব্দ। তুরস্কের জঙ্গী রাজবংশের ন্যায়পরায়ণ শাসক ‘নূর উদ্দিন জঙ্গীকে’ এখনও মুসলিমরা সম্মানের চোখে দেখেন। কারণ তিনি ছিলেন বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং অন্যায়ের বিপক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বীর যোদ্ধা/ জঙ্গী।

……………………………..

একজন বলেছেন- আপনার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। কিন্তু সবসময়েই সন্ত্রাসবাদী মতবাদীরাও নিজেদেরকে মানবতার মুক্তিবাদী সঠিক পন্থীই দাবী করেছে। অন্ততঃ তাদের সাধারণ ক্যাডার রাতো অবশ্যই । যেমনঃ কম্যুনিস্টদের বিপ্লব ও পুঁজিবাদ খতমের নামে দশ কোটি মানুষ, হিটলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গেছে । কিন্তু কম্যুনিষ্ট ও নাৎসী জাতীয়তাবাদীরাও প্রচন্ড পন্ডিত মন্য ও আদর্শ বাদী মানুষ ছিল যাঁরা পুজিবাদ ও আর্য জাতির উপর বঞ্চনা কারীদের ধ্বংস করে ইউফোরিক বিশ্ব চেয়েছে। এক পক্ষের কাছে সন্ত্রাসবাদী অন্য পক্ষের কাছে মুক্তি সেনা।

…………………….

আমার জবাব- ধন্যবাদ আপনাকে। অনৈসলামিক দিক থেকে বিচার করলে আপনার কথাগুলো বেঠিক নয়। তবে মুসলিম হিসেবে সন্ত্রাসবাদের বৈশিষ্ট্য কি তা আমাদের বুঝতে হবে।  সন্ত্রাসবাদী হওয়ার জন্য পাঁচ কিংবা দশ কোটি মানুষ মারার হিসেব কষার আগে মরা ও মারার মূল কারণটা কি তা আমাদের খতিয়ে দেথতে হবে। আল-কোরআনের নির্দেশনা অনুসারে অন্যায়ভাবে নিরপরাধ একটি মানুষ মেরে ফেলাই পৃথিবীর সকল মানুষ হত্যা করার সমান। সুতরাং মুসলিম নামধারী হোক কিংবা হোক কমুনিস্ট, নাৎসি অথবা পুজিবাদীর ধারক বাহক- যারা অন্যায়ভাবে নিরপরাধ নারী, পুরুষ, শিশুদের উপর জুলম চালায় তারাই সন্ত্রাসবাদ  অর্থাৎ Terrorism এর অনুসারী সন্ত্রাসক অর্থাৎ Terrorist. মানবতা রক্ষায় এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য মানুষ নামের এই অমানুষগুলোকে রুখতে হবে।

……………………………………

একজন প্রশ্ন ও মন্তব্য করেছেন- বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী অর্থাৎ জঙ্গীবাদী তৎপরতার বিস্তার রোধে আমাদের করনীয় কি?

আমি মনে করি, সোজা হিসাবে – রাষ্ট্র কাউকে রক্ষা করতে পারবে না – রাজনীতির নোংরা খেলায় খেলায়ারড়রা আপনার আমার সন্তানদের দাবা গুঁটি বানাতে চাইবেই। এই ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরই সন্তানদের রক্ষার কাজটা করতে হবে। এই জন্যে পৃথিবীর লাভের পিছনে ছোটাছুটির সময় কিছুটা কমিয়ে সন্তানদের সাথে সময় কাঁটানো এবং সন্তানদের মনজগতের অন্যের প্রবেশের পূর্বেই সটিক শিক্ষার মাধ্যমে ভাল আর মন্দের পার্থক্য করার মতো শিক্ষা দিতে হবে। অন্যের হাতে সন্তানের শিক্ষা পুরো দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত না হয়ে – নিজেই শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া এবং এই জন্যে নিজেই আগে শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করা। নিজেদের ঘরকেই ইসলাম চর্চার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা এবং সেখানে মুক্ত আলোচা করে সন্তানদের মতাদর্শ তৈরীতে সহায়তা করার মধ্যমে অনলাইনের ভার্চুয়াল জেহাদীদের হাত থেকে আমরা আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে চেষ্টা করা জরুরী বলে মনে করছি। একজন পিতা হিসাবে আমার উপলদ্ধিটা এমনই।

………………

আমার জবাব- একজন পিতা হিসাবে আপনার উপলদ্ধির সাথে আমিও একমত।

তবে ‘জঙ্গীবাদ’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ যে একই বিষয় নয় তা আমি উপরের আলোচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ঘরে না হয় সন্তানদের নীতি নৈতিকতা শিক্ষা দিলাম। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত অনৈতিক পরিবেশের সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারবে কি? ঘরের বাহিরে এই রাহুগ্রাসের ছোবল থেকে কি তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে?

আমাদের মনে রাখাতে হবে যে, অনাদর্শীক সমাজে বিরাজিত আক্ষেপ জনিত আদর্শীক দ্বন্দ, শোষণ কিংবা দমননীতির কারণে উগ্রবাদ/ সন্ত্রাসবাদের জন্ম হতে পারে। যা কখনই সম্পূর্ণরূপে দমন করা যায়না। উভয়পক্ষই তাদের যুক্তি ও কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিক হিসেবে দাবি করে অনঢ় অবস্থানে থাকে। এক্ষেত্রে দমিতরা নিজেদেরকে সংগ্রামী আর দমনকারীরা নিজেদেরকে সন্ত্রাস-বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা না হলে বা না করিয়ে দিতে পারলে পরিণতিতে এটি খণ্ডিত কিংবা ব্যপক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে এবং কেবলমাত্র জয়-পরাজয়ের মাধ্যমেই এই অবস্থার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাপ্তি ঘটে থাকে।

আমার মনে হয়, ঘরে নীতি নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি বাহিরের অনৈতিকতা ও অনাচারের মূলৎপাটনের জন্যও সাধ্যমত কিছু একটা করা চাই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিশ্চয় বেশ বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে।

…………………………………………….

একজন বলেছেন- আত্মঘাতি বোমরুদের সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

…………………..

আমার জবাব- বিশ্বাসী হওয়া সত্বেও ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সঠিক বুঝ ও বোধের অভাবে এবং জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য মানুষ আত্মঘাতি পথ বেছে নিতে পারে। এরূপ আত্মহনন যে অন্যায় মুসলিম হিসেবে তা মানতেই হবে।

তবে শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে প্রয়োজনে বৃহত্তর স্বার্থে বুকে বোমা বেধে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কিংবা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অস্ত্র হাতে শত্রুর বুহ্য ভেদ করে সামনা সামনি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শত্রুর বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে নিজের জীবন দেয়ার প্রয়োজন হতেই পারে। এটি অন্যায় নয় বরং সাহসিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। কোন মুসলিম এভাবে জীবন দিলে তিনি শহীদ হিসেবে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিকারী হবেন বলে আল্লাহতায়ালা অঙ্গিকার করেছেন।

কিন্তু তাই বলে বিদ্যাপিঠ, হাসপাতাল, উপাসনালয়, বসতবাড়িতে ড্রোন হামলা করে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ খুন করা যুদ্ধপরাধ এবং ভীষণ অন্যায়। অপরদিকে অস্ত্র হাতে নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে আবদ্ধ স্থানে জীম্মি বানিয়ে তাদের বুকে বুলেট মেরে বা গলায় ছুরি চালিয়ে কিংবা কোমড়ে বোমা গুঁজে বা বোমা ভর্তি ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যুদ্ধের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক নেই সেরূপ সাধারণ জনতার মাঝে আচমকা তা ফাটিয়ে নিজে মরা এবং অন্যদের মারা নিশ্চয় অনেক বড় অপরাধ। এটি আত্মহত্যা করার সাথে সাথে অপরকে খুন করার মত অর্থাৎ একসাথে দুইটি অপরাধ করার সামিল। এটি কখনই বীরত্বের কাজ নয়। কেউ এমনটি করলে তাকে উন্মাদ কিংবা ধর্মান্ধ বললে কমই বলা হবে, বরং তাকে কাপুরুষ ও পাষণ্ড ছাড়া আর কিইবা বলার থাকে। সুতরাং সাবধান! মুসলিম মাত্রই বুঝে শুনে পা ফেলা চাই। পা পিছলে এরূপ জঘন্য কর্মে জড়িয়ে পড়লে পরিণতিতে ইহকালে বঞ্ছনা এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তি অপেক্ষা করছে।

……………………………………..

একজন বলেছেন- ইসলামে সন্ত্রাস অর্থাৎ জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আহলে সুন্নাহ চৌদ্দশ বছর যাবৎ জিহাদ ও কিতালকে এই দৃষ্টিতে দেখেছেন । চার খলিফা হতে শুরু করে আহলে সুন্নাহর ও হানাফি মাজহাবের অনুসারী মোঘল, দিল্লি সালতানাত, উসমানি খিলাফত সবাই প্রকৃত জিহাদ ও কিতালেই বিশ্বাস করতো। বিংশ শতাব্দীর বাতিল জংগি ইসলামের দুশমন খারেজি আল কায়েদা, আইএস, হারামি, জেএমবি প্রমূখরা পৃথিবীর বিভিন্ন জংগি,  গেরিলা গোষ্ঠীর অনুসরণ করে ও ইহুদিদের ফাঁদে পড়ে মহা পবিত্র জিহাদকে সন্ত্রাস বানিয়ে, ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত করে ইসলামের চরম ক্ষতি করলো। হককানি জামাত আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর দৃষ্টিতে জিহাদ ও কিতাল সম্পর্কে জানতে নিচের লিংকের লেখাটি পড়বেন-

বর্তমান বিশ্বে বা আমাদের দেশে ইসলামের নামে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে এগুলো ইসলামসম্মত নয়, সত্যিকার জিহাদের ব্যাপারে ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যেই একটি শান্তিপূর্ণ দেশে জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করা হচ্ছে- শায়খুল হাদিস মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ

………………….

আমার জবাব- হাঁ, ইসলামে সন্ত্রাস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গীবাদ যে একই নয় তা আমি আগেই বলেছি।

প্রবন্ধের মূল বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে সচেতন মুসলিম হিসেবে কিছু মন্তব্য ও মতামত ব্যক্ত করছি-

প্রবন্ধে উল্লেখিত-//ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোনো সুযোগ নেই। সন্ত্রাসকে লালন করা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কোনো ইতিহাস ইসলামে নেই।//

আল-কোরআন ও হাদিছ অনুসারে এই বক্তবের সাথে আমি সম্পূর্ণরূপে একমত।

প্রবন্ধে উল্লেখিত-//ইসলামের প্রথম যুগে ছিল মজলুম হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকে সহ্য করা এবং শেষের দিকের ইতিহাস হলো সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হওয়ার কারণে সন্ত্রাসকে দমন করার ইতিহাস। বর্তমানে যা চলছে এটা কোনোভাবেই জিহাদ নয়।//

তাহলে ইসলামে জিহাদের ইতাহাস কোনটি। রাসূল (সাঃ) এবং চার খলিফার শাসনামলের পর আর কখন এবং কোথায় জিহাদ হয়েছিল তার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হত। আশাকরি এ বিষয়ে কিছু বলবেন।

প্রবন্ধে উল্লেখিত-//যখন একটি দেশ দলবদ্ধভাবে জবরদস্তি একটি নিরীহ দুর্বল দেশের ওপর হামলা করে, অন্যায়ভাবে তাদের নারী-পুরুষ নিরপরাধ লোককে হত্যা করবে, মাটিকে রক্তরঞ্জিত করবে তখনই ইসলামে রাসূলের মাদানি যুগের মতোই চূড়ান্ত জিহাদের বিষয় আসতে পারে। সেটা হলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ। সেই পরিস্থিতি তো বাংলাদেশে হয়নি।

কতজন নারী-পুরুষ ও নিরপরাধ লোককে হত্যা করলে, কতখানি মাটিকে রক্তরঞ্জিত করলে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জিহাদ হতে পারে? পবিত্র কোরআন ও হাদিছ থেকে এর পক্ষে কিছুটা উল্লেখ থাকলে বিষয়টি পরিষ্কার হত। এই বক্তব্যের পেক্ষাপট বিবেচনায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেকে আপনি/ আপনারা কি বলবেন? ইমানদারদের জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম এবং তার পর অস্ত্র হাতে যুদ্ধটা কি জিহাদ তথা কিতাল হিসেবে গন্য হবে?

প্রবন্ধে উল্লেখিত-//আল কুরআনের সূরা মায়েদার ৩৩ নম্বর আয়াতে জমিনে ফ্যাসাদ বা সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কয়েক ধরনের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে।//

উল্লেখিত প্রবন্ধের এত কথার মাঝে পবিত্র কোরআন থেকে একটি মাত্র আয়াতের শুধুমাত্র নম্বরটি উল্লেখ করা হয়েছে। সাথে অনুবাদটি দিয়ে দিলে ভাল হত। এরূপ ভাসা ভাসা বক্তব্যের কারণেও সাধারণ মানুষেরা অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। জিহাদ ও কিতাল সম্পর্কে আরও অনেক আয়াত আছে যার মর্ম ভালভাবে না জেনেই খণ্ডিতভাবে পড়েই অনেকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকছেন। তাছাড়া বাজারে তো অনেক ধরনের ব্যাখা বিশ্লেষণের অভাব নেই। তাই কোরআনের সকল আয়াত ও সহী হাদিছের আলোকে জিহাদ এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে কিতাল সম্পর্কে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা নিলে প্রকৃত বিষয়টি সবার কাছে ফুটে উঠবে। ফলে জনগণের মধ্য থেকে বিশেষ করে আমাদের যুব সমাজের একটি অংশ যারা সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকছেন তারা দমিত হবেন এবং প্রয়োজনে যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে প্রকৃত জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবেন-ইনশাল্লাহ।

প্রবন্ধে উল্লেখিত-//আসলে কুরআনে যেটা বলা হয়েছে, ইহুদি মুশরিকরা হলো ইসলামের শক্র। এরা যুগে যুগে সরাসরি ইসলামের বিরোধিতা করেছে। মুসলমানদের মেরে ফেলে দুর্বল করা এবং বিশ্বে নিজেদের নেতৃত্ব দেয়ার কৌশল তারা অবলম্বন করেছে।//

কিন্তু তারপরও মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ এই বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সহ সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ পরস্পর সম্প্রীতি রক্ষা করে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করে আসছেন। তবে ইদানিং কিছু সাম্পদায়িক মানুষ অসাম্প্রদায়িকতার বোলচাল মেরে দীর্ঘদিনের লালিত বন্ধুসুলভ পরিবেশকে কলুসিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সত্যকে না জেনেই কিংবা স্বার্থ হাসিলের জন্য একদল ধর্মের নামে এবং আরেকদল অধর্মের নামে কাদা ছুড়াছুড়ি করছেন। যা খুবই আপত্তিকর। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সচেতন কোরে তোলার সাথে সাথে সময়মত যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বড় রকমের মাশুল দিতে হতে পারে। তাই শান্তির স্বার্থে উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেয়ার এখনই সময়।

…………………………..

একজন বলেছেন- ইসলামি রাষ্ট্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে হয়না। যখন আবার সাহাবা রাঃ এর মতো ঈমানি শক্তিতে বলিয়ান আল্লাহ্ ভীরু মুসলমান তৈরি হবে, তখন রাজত্ব আল্লাহ্ ই দান করবেন ।

………………

আমার জবাব- হাঁ, ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নেই। যারা ইসলাম কায়েমের নামে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়, তারা নিশ্চয় ভুল পথেই আছে। তথাকথিত সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা অর্বাচিনের অলিক কল্পণা ছাড়া কিছুই না। তবে এরজন্য ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে অন্যায় ও অবিচার রোধে ও মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ ও কিতাল করার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। মানসিক ও সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সক্ষমতা অর্জন করতে পারলে নিশ্চয় মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের জন্য যোগ্য প্রতিনিধি ও শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন। প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্রে লোকদেখানো বোলচাল ও বিলাসিতা নয়, বরং মানবতা ও সকল মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে, সকল অন্যায় ও অবিচার দূরীভুত হবে এবং ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। ।

Comments are closed.