কোরানের আলোকে নামাজ কি?

কোরানের আলোকে নামাজ কি? এর তাৎপর্য কি ও সঠিক পন্থা কি ?
অনেকেই গতানুগতিক ভাবে নামাজ পড়ে কিন্তু, নামাজকে আমরা ঠিকমতো বুঝার চেষ্টা করিনা!
একটু খেয়াল করুন নামাজে আমরা কি করি নামাজে আমাদের শারীরিক তিন অবস্থান কে আল্লাহ চিত্রায়িত করেছেন এই ভাবে কিয়াম করা, রুকু করা, এবং সিজদাহ করা।
আমরা আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শুরু করি, এবং এই তাসবীহ টি আমরা বার বার বলি নামাজের শুরুতে এবং প্রতিবার আমাদের শারীরিক অবস্থানের পরিবর্তনের সময়।
আল্লাহু আকবার একটি যিকর এবং তাসবীহ এবং আল্লাহ্পাকের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, শির্কের অস্বীকৃতি; এবং নিজের নাফ্সের কোনো কর্তৃত্ব কে, দাসত্বকে, বড়োত্বকে অস্বীকার করা।

আর কিয়ামে আমরা কি করি, প্রথমে সুরাহ ফাতিহা পড়ে বিনয় অর্জনের এবং অহংকার বর্জনের স্বীকৃতি দেই এবং বিনীত অন্তরে আল্লাহর কাছে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলার জন্য আল্লাহর কাছে মিনতি করি, কাতর প্রার্থনা করি। এবং এই কাতর প্রার্থনার জবাব হিসেবে আল্লাহর কাছ থেকে দেয়া কোরানকে তেলাওয়াত করি হেদায়েত পাবার জন্য।

কিভাবে তেলওয়াত করতে হবে?
অত্যন্ত বিনয়ের সহিত বুঝে শুনে। তাহলেই আমাদের বিনয় আরো বেড়ে যাবে।
আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল আরো করেছেন,
নামাজে তাকবীর-“আল্লাহু আকবার” বিশেষভাবে নামাজে পড়তে হয় এবং কিয়াম এবং রুকু এবং সিজদাহ তাকবীর বলেই করতে হয়।
আল্লাহ্পাক তাঁর রাসূল কে হুকুম দিয়েছেন বেশি করে তাকবীর পড়ার তাই আমরাও তাকবীর পড়ি এবং এই হুকুমের ই বহিঃপ্রকাশ হয়েছে নামাজে তাকবীর বেশি পড়ার মধ্যে দিয়ে:
وَكَبِّرۡهُ تَكۡبِيۡرًا
আর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো, চূড়ান্ত পর্যায়ের শ্রেষ্ঠত্ব। বনী ইস্রায়েল -১১১
কিন্তু কেন এই এতবার তাকবীরের প্রাধান্য?
এই তাকবীরের লক্ষণীয় প্রাধান্য এই কারণে যে,
আমরা নামাজের শুরুতে এবং নামাজের ভিতরে বার বার ঘোষণা করছি যে আল্লাহই একমাত্র শ্রেষ্ঠ, আল্লাহই একমাত্র সব চেয়ে বড়ো, শ্রেষ্ঠত্বের হকদার আর কেউ হতে পারেনা।
আমার মন প্রাণ ঘোষণা করছে বার বার যে আল্লাহ সকল গৌরবের প্রশংসার মালিক
আমার নাফস বা আল্লাহর কোনো সৃষ্টি আমার কাছে বড়ো নয়
আল্লাহর হুকুম ই আমার কাছে বড়ো,
আল্লাহর ইচ্ছাই আমার কাছে বড়ো
এই বড়ত্ব ঘোষণা করেই আমরা রুকু এবং সিজদাহতে যেয়ে আল্লাহকে সুবহান বলি তাঁর প্রশংসা সহ।
আল্লাহ্পাক সিজদাহ করতে বলেছেন প্রশংসা সহ তাসবীহকে একসাথে করে :
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُن مِّنَ السَّاجِدِينَ সূরা হিজর ১৫ :৯৮
আর রুকু সিজদাহ হচ্ছে শারীরিকভাবে বিনয়ের প্রদর্শন মাথা ঝুকিয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ
অর্থাৎ নামাজ বাহ্যিকভাবে- শারীরিকভাবে , মৌখিকভাবে এবং মানসিকভাবে আমাদেরকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ শিখায়
তাই,
আল্লাহ্পাক বলছেন আল্লাহর যিকর এবং তাসবীহ করতে হবে বিনয়ী হয়ে, ভীত বিহ্বল হয়ে শারীরিকভাবে
কেউ যখন সত্যিকার অর্থে বিনয়ী হয়ে বুঝে কিয়ামে কোরান তেলাওয়াত করবে, রুকু করবে এবং সিজদাহ করবে তখন তাদের অবস্থা হবে যা আল্লাহ নিচের আয়াতে বলেছেন
﴿وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا ۩﴾
১০৯) এবং তারা নত মুখে কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়ে এবং তা শুনে তাদের দীনতা আরো বেড়ে যায়৷ বানু ইসরাঈল
কোরানের আয়াত ই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কে কেঁদে কেঁদে রুকু সিজদায় পরে যেতে বাঁধ করে বিনয় সৃষ্টির মাধ্যমে:
اِذَا تُتۡلٰى عَلَيۡهِمۡ اٰيٰتُ الرَّحۡمٰنِ خَرُّوۡا سُجَّدًا وَّبُكِيًّا ۩‏
দের অবস্থা এই ছিল যে, যখন করুণাময়ের আয়াত এদেরকে শুনানো হতো তখন কান্নারত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়তো। মারিয়াম :৫৮
উপরের আয়াতে আল্লাহ্পাক বলছেন যে পূর্বে যাদেরকে কিতাবের জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা কোরানের কথা শুনে সিজদায় পরে যেত এবং তাতে তাদের খুশু আরো বেড়ে যেত
কেউ যখন নামাজে মনোযোগ দিয়ে ভীতবিহ্বল হৃদয়ে কোরান শুনে , তেলওয়াত করে তা আল্লাহভীতি এবং খুশু বাড়িয়ে দেয়।
নিচের আয়াতে সফলতার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে বিনয়কে নামাজের সময়ের জন্য বিশেষভাবে শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। তবে সেই বিনয় আসে সঠিক ভাবে অর্থ সহ হৃদয় দিয়ে বুঝে কোরান তেলওয়াত এবং যিকর করার মধ্যে দিয়ে।

قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَۙ
১) নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা
الَّذِيۡنَ هُمۡ فِىۡ صَلَاتِهِمۡ خٰشِعُوۡنَۙ‏
২) যারা নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়,
আরো দেখুন নামাজ যেটি সবচেয়ে বড়ো যিকর তা কিভাবে করতে হবে?
তা করতে হবে ভীতি সহ বিনীত অন্তরে:
وَاذۡكُر رَّبَّكَ فِىۡ نَفۡسِكَ تَضَرُّعًا وَّخِيۡفَةً وَّدُوۡنَ الۡجَهۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ بِالۡغُدُوِّ وَالۡاٰصَالِ وَلَا تَكُنۡ مِّنَ الۡغٰفِلِيۡنَ
২০৫) হে নবী!তোমার রবকে স্মারণ করো সকাল-সাঁঝে মনে মনে বিনয়ের সহিত ও ভীতি বিহ্বল চিত্তে এবং অনুচ্চ কণ্ঠে। তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না যারা গাফিলতির মধ্যে ডুবে আছে। (সূরা আরাফ) কোরান আমাদেরকে এখানে বিনয়, ভয়, অনুচ্চ স্বরে – বেশি বড়ো বা একেবারে অনুচ্চভাবে নয় , কোরান পড়তে বলেছেন, নামাজের তাসবীহ করতে বলেছেন, এমন ভাবে বুঝে কোরান তেলাওয়াত ও তাসবীহ করতে হবে যেন তা সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর যিকর হয় আর যিকর ই হচ্ছে নামাজের উদ্দেশ্য এবং যিকর ই সবচেয়ে বড়ো বলে আল্লাহ্পাক বলেছেন :
(তাহা ২০ :১৪) : إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
Al-‘Ankabut 29:45 : اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ
দেখুন আল্লাহ পাক নিচে নামাজের উদ্দেশ্য এবং নামাজিদের বৈশিষ্ট কি উল্লেখ করেছেন:
Al-Fath 48:29
تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ
এখানে নামাজের উদ্দেশ্য বলা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ
এবং নামাজিদের মাঝে রুকু ও সিজদাহ করার কারণে চেহারায় সিজদাহর লক্ষন প্রতিফলিত হবে।
খেয়াল করুন, রুকু সিজদা দুইটি আমল হলেও আল্লাহর পাক সিজদাহর লক্ষণের কথা বলেছেন, কারণ হলো রুকু হচ্ছে অর্ধেক সিজাহ বা সিজদাহর একটি রকম এবং রুকু এবং সিজদাহ মিলে আসলে একটি আমল তার নাম সিজদাহ প্রকৃত আত্মসমর্পণ – বিনয়
তাকবীর এবং কিয়ামে কোরান তেলাওয়াত করার পর আল্লাহ পাক তাসবীহর জন্য
জোর দিয়েছেন ;
রাতের দীর্ঘ সময় ধরে তাসবীহ করার জোর দিয়েছেন এবং সিজদাহ করতে বলেছেন:
وَمِنَ اللَّيْلِ فَاسْجُدْ لَهُ وَسَبِّحْهُ لَيْلًا طَوِيلًا
২৬) রাতের বেলায়ও তার সামনে সিজদায় অবনত হও। রাতের দীর্ঘ সময় তাঁর তাসবীহ অর্থাৎ পবিত্রতা বর্ণনা করতে থাকো।সূরা ইনসান
দেখুন সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর প্রশংসা সহ সুবহানাল্লাহ বলে তাসবীহ করতে বলেছেন
فَسُبۡحٰنَ اللّٰهِ حِيۡنَ تُمۡسُوۡنَ وَحِيۡنَ تُصۡبِحُوۡنَ
১৭) কাজেই আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় এবং যখন তোমাদের সকাল হয়।
وَلَهُ الۡحَمۡدُ فِىۡ السَّمٰوٰتِ وَالۡاَرۡضِ وَعَشِيًّا وَّحِيۡنَ تُظۡهِرُوۡنَ‏
১৮) আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই প্রশংসা এবং (তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমাদের কাছে এসে যায় যোহরের সময়। সূরা রুম
এই হুকুম টির বাস্তবায়ন হয়েছে এইভাবে যে সুবহানাল্লাহ বলার পর আমরা রুকুতে আজীম বলি এবং সিজদাহতে আ’লা বলি সর্বোচ্চ প্রশংসা করার জন্য
কিন্তু সুবহানাল্লাহর অর্থ কি? সুবহানাল্লাহর বলার তাৎপর্য কি?
সুবহানাল্লাহ শব্দটি ইসমুল মুবালাগাহ এবং মাফ’উল মুতলাক একই সাথে
ইসমুল মুবালাগা এবং মাফুল মুতলাক এক্সট্রিম সবচেয়ে বেশি অ্যাকশন কে নির্দেশ করে
আমরা যখন বলি সুবহানাল্লাহ এইটার অর্থ হয় আমি আমি আল্লাহ পাকের সবচেয়ে বেশি পবিত্রতা ঘোষণা করছি। সত্যিকারের বিনয়ের সিজদাহ বেশি করে করলে, সেই সিজদাহ গোনাহ মাফের, দারাজাহ বৃদ্ধির কারণ হয় ।
‏ “‏ عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَكَ اللَّهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً ‏”‏ : সহীহ মুসলিম: ৪৮৮
যদি আমরা সত্যিকারের আত্ম সমর্পনের সিজদাহ করতে পারি, তাহলে সেই সিজদাহ আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে এবং এই সফল সিজদাহতে দুআ করলে আল্লাহ পাক আমাদের দুআ কবুল করবেন, তাই আল্লাহর রাসূল বেশি করে দুআ করতে বলেছেন সিজদাহতে :
আবু হুরাইরা বর্ণনা করেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ ‏”‏ ‏.‏
সহীহ মুসলিম: ৪৮২
বেশি করে বেশি সময় নিয়ে সিজদাহ করলে আল্লাহর রাসূলের সাথে কাল হাশরে এবং জান্নাতে থাকার সুযোগ হবে ইনশাআল্লাহ
عَنْ رَبِيعَة بْن كَعْبٍ الْأَسْلَمِيُّ قَالَ كُنْتُ أَبِيتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَتَيْتُهُ بِوَضُوئِهِ وَحَاجَتِهِ فَقَالَ لِي سَلْ فَقُلْتُ أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنَّةِ قَالَ أَوْ غَيْرَ ذَلِكَ قُلْتُ هُوَ ذَاكَ قَالَ فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ ;সহীহ মুসলিম ৪৮৯
শুধু নামাজের রাকাআত সংখ্যা নয় সত্যিকারের নামাজের রূহ হলো বেশি বেশি আল্লাহর তাসবীহ করা রুকু ও সিজদায় আল্লাহর প্রশংসা সহ , আল্লাহর কাছে হেদায়েতের নিয়তে কিয়ামে কোরান তেলাওয়াত করা তারতীলের সহিত এবং নামাজে সর্বত্র মন ও দেহে বিনীত হয়ে আমরা যখন সুবহানাল্লাহ বলি রুকুতে, আমরা আসলে বলি আল্লাহ্পাকের হুকুম অনুযায়ী যে:
ওহ আল্লাহ আমি অনেক বেশি পরিমান পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি আমার রব এবং যিনি আজিম যিনি বিশাল মহান শ্রেষ্ঠ
সিজদাহতে বলি ওহ আল্লাহ আমি আপনার অনেক বেশি পরিমান পবিত্রতা ঘোষণা করছি যিনি আমার রব যিনি সকল কিছুর উপরে তিনি ই শ্রেষ্ঠ তার গুণাবলীই সবচেয়ে উপরে
এই ভাবে যদি আমার কিয়াম করি তারতীল এর সহিত , বিনয়ের সহিত বুঝে শুনে এবং রুকু সিজদাহ তে তাসবীহ করি বুঝে শুনে তাহলেই আমাদের সত্যিকারের নামাজ হবে
আল্লাহ -পাক আমাদেরকে নামাজের তাৎপর্য বুঝার তৌফিক
এবং সত্যিকারের রুহানি নামাজ পড়ার তৌফিক দিন।

Comments are closed.