কবিতায় সাধু ও চলতি রূপের মিশ্রণঃ

বন্ধুরা শুভেচ্ছা নিন। আলোচনার আসর ইদানিং বেশ কিছুদিন যাবত ঝিমিয়ে আছে! নতুন কোন আলোচনার সূত্রপাত না হলে আলোচনার আসর সরব হয় না। আর সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা সরব না হলে আমরাও কিছু শিখতে পারি না। কাজেই, ভুল হোক শুদ্ধ হোক; একটা কিছু দিয়ে মৌচাকে খোঁচা দিলে যৌক্তিক প্রয়োজনে গুণীজন নিশ্চয়ই আলোচনায় এগিয়ে আসবেন! সেই সুবাদে আমরাও কিছু শিখতে পারব! তেমন প্রত্যাশায় আমি একান্তই নিজের কিছু অভিব্যক্তি এখানে তুলে ধরছি। আমার মতের সাথে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে – যুক্তি-উপমায় তাঁদের মতামত তুলে ধরার জন্য সকল কবি বন্ধুর কাছে সনির্বন্ধ আহ্বান জানাচ্ছি।

ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময়ে নানান বিষয়েই আলোচনার সূত্রপাত করেছি। আজ আমি সাহিত্যে (গানে, গল্পে, কবিতায়) বাংলাভাষার সাধুরূপ ও চলতিরূপের মিশ্রণ বা ব্যবহারে বিষয়ে দু’টি কথার অবতারণা করছি। বিজ্ঞ বন্ধুরা এবিষয়ে নিজ নিজ অভিমত সহ প্রতীতযশা ব্যক্তিবর্গের মতামত তুলে ধরলে আমার এই উপস্থাপনা সার্থক হবে; সাহিত্য বিষয়ে জানা অজানা কিছু তথ্য ও তত্ত্ব জেনে আমরাও খানিক লাভবান হতে পারি!

বাংলাভাষায় যে দু’টি রূপ বিদ্যমান তারমধ্যে বর্তমানে কেবল চলতি-রূপটাই টিকে আছে। ক্রমে ক্রমে সাধু-রূপটি হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ দুই তিন যুগ আগেও কিছু পত্রিকার ভাষায়, দলিল সম্পাদনার কাজে, চিঠিপত্রে আর কতিপয় লেখকের গল্প কবিতায় সাধুরূপটি ধুঁক-ধুঁক করে টিকে ছিল। সম্প্রতি তা ও হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন সর্বত্রই ভাষার এমন শ্রুতিমধূর সাধু-রূপটি যেন প্রবেশাধিকার হারিয়ে ফেলেছে।

অধুনা কোন পত্রিকায় তো নয় ই, কতক রম্য-আলোচনা বা রম্য-গল্প ছাড়া আর কোন ক্ষেত্রেই সাধুভাষার ব্যবহার দেখছি না। বিষয়টা নিয়ে ভাষাবিদ ও বিজ্ঞজন কি ভাবছেন এটা জানার খুবই কৌতুহল জাগে। তবে কি বাংলাভাষার এক সময়ের অলংকার- ওই সাধু-রূপটি চর্যাপদের মতই কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে? ভাষা-বৈচিত্রে বলিয়ান আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাধু-রূপটি হারিয়ে গেলে বাংলাভাষার যে কত ক্ষতি হবে তা কি ভাষাবিদ ও ভাষাপ্রেমী বিজ্ঞজনরা ভেবে দেখেছেন?

আমরা জানি শিল্প-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে কোন বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না। সংস্কৃতি তার সমসাময়িক সময়ের বাস্তবতায় আপন নিয়মেই আবর্তিত হতে থাকে। তাকে চর্চার মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে হয়। আর সংস্কৃতির চার্চা্ ও বিকাশের প্রধান মাধ্যমই হল ভাষা। সুতরাং, সংস্কৃতির স্বার্থেই প্রতিটা জাতি তার ভাষাকে পরিশীলিত ও সমৃদ্ধ রাখে। অতএব, আমাদের ভাষার একটা অঙ্গ এই সাধুরীতিটা সংরক্ষণ করাও আমাদের কর্তব্য নয় কি?

শরৎ-রবীন্দ্র যুগের পর থেকে সাহিত্যে সাধুরীতির যে আকাল দেখা দিয়েছে তা ক্রমশঃ কমতে কমতে এখন কালে-ভদ্রে কোন কবিতা বা গানে কেবল অলংকরণের স্বার্থে বিচ্ছিন্নভাবে ছিঁটেফোঁটা দু’একটি শব্দ ঢুকতে দেখলেও ভাষার জাত গেল বলে অনেকেই হৈ হৈ করে তেড়েফুঁড়ে আসেন! অথচ ভিনদেশী ভাষা সরাসরি দিলে বা ইংরেজী বানানে দিলেও তাকে আধুনিক জ্ঞানে মেনে নিচ্ছেন।

আজকাল কেউ আর বিশুদ্ধ সাধুভাষাতে কোন সাহিত্য রচনা করেন না। গল্পে, প্রবন্ধে, বক্তৃতায় সাধু ও চলিতভাষার মিশ্রণে সেই বিষয়সমূহের সৌন্দর্য হারায় বলে একই লেখায় সাধু-চলতি’র মিশ্রণকে দূষণীয় ভাবা হয়। কিন্তু যতদূর জানি গান কবিতা বা শ্লোক উপমায় সাধু-চলতিরূপের যথার্থ মিশ্রণ সৌন্দয়ের ক্ষতি তো করেই না বরং অনেক ক্ষেত্রে সুষমা বাড়ায়। আমাদের আদিপুরুষগণ কিন্তু এটাকে দূষণীয় ভাবেন নি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত; ভাষার দু’টি ধারাই সমভাবে চর্চিত হলে একই লেখায় দুই ধারার মিশ্রণ পরিত্যাগ করা যেতে পারে। অন্যথায় ছন্দ ও লয়ের সুবিধার্থে ভাষাকে শ্রুতিমধুর করতে প্রয়োজনে অলংকারের মতই সাধুরুপের ব্যবহার চলতে পারে।

পোস্ট-মডার্ণ এই যুগে অনেকের কাছে সাধুভাষাটা সেকেলে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সাধুভাষার যে একটা রাজসিক ও গুরুগম্ভীর আভিজাত্য বোধ ছিল তা কেউ স্বীকার করেন না। আমি কবিতায় শব্দ প্রয়োগে সাধু-চলিতের বিভেদকে বড় করে দেখি না বলে অনেক বন্ধুই আমাকে সেকেলে ভাবেন। আমার কাছে যে শব্দটা মনে হয় শ্রুতিমধুর, ছন্দে-লয়ে খাপ খেয়ে যায় তা সাধুরূপ হলেও অবলীলায় ব্যবহার করি। এমন কতক ক্ষেত্র আছে যেখানে ক্রিয়াপদের চলতিরুপের চেয়ে সাধুরুপটিই বেশী জুতসই ও শ্রতিমধুর লাগে। সেসব ক্ষেত্রে চলতিরূপের যথার্থ প্রতিশব্দ কোন ভাবেই যেন খাপ খায় না।

বাংলাভাষায় ক্রিয়াপদ ও বিশেষণপদের কিছু সাধুরূপের শব্দ ছাড়াও অনেক শব্দ আছে যা আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি না। মাঝে মাঝে এগুলো গানে গল্পে কবিতায় উপমায় ব্যবহার না হলে ক্রমেই যে সেই শব্দগুলো হারিয়ে যাবে! কাজেই আমি সাহিত্যে ওসব শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতি। ভাষার সাধুরূপ তো প্রায় উঠেই গেছে। অথচ একে টিকিয়ে রাখতে হলে গানে গল্পে কবিতায় শ্লোকে উপমায় এগুলোর ব্যবহার হওয়া উচিৎ। কেবলই সাধুরূপের রচনাও এযুগে ভাল শোনায় না। তাই মাঝে মাঝে চলিতরূপের পাশাপাশি সাযুজ্য ক্ষেত্রে সাধুরূপ ব্যবহারে ভাষা ও শ্রুতির মাধুর্যতা আনে বৈকি!

নিজ নিজ মতামত তুলে ধরার জন্য সবাইকে আন্তরিক আহ্বান ও ধন্যবাদ রইল।

Loading

অনিরুদ্ধ বুলবুল

About অনিরুদ্ধ বুলবুল

ব্যক্তির সমষ্টিই সমাজ। আমি সেই সমাজেরই অংশ। যে সমাজে বাস করছি সেই সমাজের উন্নয়ন আমার স্বপ্ন। সমাজের যেকোন অনিয়ম অসংগতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ইচ্ছা হয়; সুযোগ পেলে সমাজটাকে বদলিয়ে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলি। সমাজের প্রতি সেই দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের কিছু ইচ্ছা, অভিপ্রায় ও মতামত উপস্থাপন করে সমমনা পাঠকেদের সাথে তা শেয়ার করার মানসে মাঝে মাঝে কিছু লিখি। তাতে সমাজের সামান্যতম উপকার হলেও নিজেকে ধন্য মনে করি।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *