ইসলামে রোজা বা সিয়াম

রমাদান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারি রূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।

 দীর্ঘ দুই মাসে দোয়া ও প্রার্থনা ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমাদান আমাদের নসিব করুন!’ এই আকুল প্রার্থনা কবুল হলো। আজ তা বাস্তবে পরিণত হলো। তাই আনন্দচিত্তে স্বাগত জানাচ্ছি ‘আহলান সাহলান মাহে রমাদান’ বা ‘সুস্বাগত মাহে রমাদান’।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যখন রমাদান মাস আসে তখন বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়; শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী শরিফ, সওম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ:  ১,১৮৭, খণ্ড: ৩,  হাদিস: ১,৭৭৮)।

 হিজরি চান্দ্রবর্ষের নবম মাসের আরবি নাম রমাদান। ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা উচ্চারণে এটি হয় রমাজান বা রমজান। রমাদান বা রমাজান শব্দের অর্থ হলো প্রচণ্ড গরম, সূর্যের খরতাপে পাথর উত্তপ্ত হওয়া, সূর্যতাপে উত্তপ্ত বালু বা মরুভূমি, মাটির তাপে পায়ে ফোসকা বা ঠোসা পড়ে যাওয়া; পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া; সেদ্ধ হওয়া, কাবাব বানানো; ঘাম ঝরানো; চর্বি গলানো; জ্বর, তাপ ইত্যাদি। রমাদানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; তাই এই মাসের নাম রমাদান। রমাদান মাসে পাপ-তাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এই মাসের নাম রমাদান।

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

সাহরু রামাদানাল্লাযি উনযিলা ফিহিল কুরআনু হুদালিন নাসি ওয়া বাঈয়েনাতিম মিনাল হুদা ওয়াল ফুরকানি ফামান শাহিদা মিনকুমুস শাহরা ফাইয়াসুমহু ওয়া মান কানা মারিদান আও আলা সাফারিন ফাইদ্দাতুম মিন আইয়ামিন উখারা ইউরিদু আল্লাহু বিকুমুল ইউসরা ওয়ালা ইউরিদুবিকুমুল উসরা ওয়ালিতুকমিলুল ইদ্দাতা ওয়া লিতুকাব্বিরু আল্লাহা আলা মা হাদাকুম ওয়া লায়াল্লাকুম তাশকুরুন।

 রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়েতের জন্য এবং হেদায়েতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে হেদায়েত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। সূরাহ বাকারাহ, আয়াত ১৮৫।

  রোজাকে আরবী ভাষায় ‘সিয়াম’ বলা হয়। সিয়াম হচ্ছে বহুবচন, এর একবচন হচ্ছে সওম অর্থ বিরত থাকা। ফারসী, ঊর্দু, হিন্দি ও বাংলায় সওমকে বলা হয় রোজা।

  রমজান হিজরী বছরের নবম মাস। এটি সংযম ও তাকওয়া অর্জনের মাস। রমজান মাসে মুসলিম জাহান  পূণ্যের মহিময় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে পড়ে। কলেমার সুর, আজানের ধ্বনি, তেলায়াতে কুরআন দিক বিদিক মুখরিত করে তোলে। একত্বে বিশ্বাসী মুসলিমের প্রাণ পূণ্যের আভায় কানায় কানায় ভরে উঠে। ঐশী প্রেম ও পরকালের অনন্ত সুখ লাভের আশায় রোজাদারকে চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করতে থাকে। তাই সে দিবারাত্রি আল্লাহর ইবাদত করেও ক্লান্তি বোধ করে না; বরং অধিক পূণ্য লাভের আশায় সে দিবারাত্রি কুরআন তেলায়াত করে। প্রত্যুষে যৎসামান্য পানাহার করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস থেকে সর্ব প্রকার অনাচার, অশ্লীলতা, মিথ্যাচার থেকে বিরত থেকে ফরজ রোজা পালন করে ও অধিক পূণ্যের আশায় রাতে তারাবীর   নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করে থাকে। অধিকন্তু অধিক পূণ্যের আশায় তারাবীর নামাজ ছাড়াও সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজও আদায় করে। সর্বোপরি ইসলামের পূর্ব শর্ত হালাল উপায়ে আয়  ও হালাল পথে ব্যয় পুরাপুরি মেনে চলার চেষ্টা করে। নতুবা তার সারা মাসের ইবাদত বিফলে যাবে। আল্লাহ ভীতি তার মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে জাগ্রত থাকে।

    মহান আল্লাহ পাক কুরআনুল কারীমে ঘোষনা করেছেন —

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ﴿١٨٣﴾

(ইয়া আইয়োহাল্লাযিনা আমান্যু কুতেবা আলাইকুমু সিয়ামু কামা কুতেবা আ’লাল্লাযিনা মিন কাব্লিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন)

 হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেয়া  হয়েছিলো, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারো। (সূরা বাকারা আয়াত ১৮৩)

 আল্লাহর এই বিধানের মর্যাদা দিতে মুমিনগণ নিজের জীবনকে কোরবান করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। এই মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এ মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। অন্যান্য মাসে একটা সৎ কাজের জন্য যে সওয়াব পাওয়া যায় এ মাসে সত্তর থেকে সাতশ’ গুণ বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। এতেই বুঝা যায় এমাসের মর্যাদা কত বেশী। মহানবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – মহান আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর বদলা দিব। হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেন – জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে যে দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করবে।

  রমজান মাসে দান খয়রাত করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায় বলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন। তিনি নিজেও এ মাসে সবচেয়ে বেশী বেশী দান করতেন। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অমিয় বাণীর মর্মানুযায়ী মোমেন ব্যক্তি এ মাসে অধিক পরিমাণে দান খয়রাত  করে থাকেন। তিনি নিরন্নকে অন্ন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র এবং অধিক পরিমানে যাকাত ও দান খয়রাত আদায় করে এক অনিন্দনীয় আত্মিক সুখের অধিকারী হয়ে থাকেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – যে রোজাদারকে ইফতার করায় সে রোজাদারের রোজা রাখার সমান পূণ্য অর্জন করে, অথচ  তজ্জন্য রোজাদারের পূণ্য একটুও কমে না। তাই তিনি রোজাদারকে ইফতার করাতেও যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকেন।

  রোজার সামাজিক তাৎপর্যও অত্যধিক। প্রথমতঃ নামাজের চেয়ে রোজার সামাজিক গুরুত্ব নিতান্ত কম  নয়। সাধারণতঃ রমজান মাসে রোজাদার ব্যক্তি অধিক পরিমাণে জামায়াতে নামাজ পড়ে থাকেন।   জামায়াতকে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মিলন কেন্দ্রও বলা যেতে পারে। এখানে ধনী-দরিদ্র,অনাথ-আতুরের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য থাকে না। তাই এখানে ধনী-গরীবের মিলন সংঘটিত হয়ে  ভ্রাতৃত্ববোধে সবাইকে আগ্রহী করে তোলে।

  দ্বিতীয়তঃ রোজা ধনী-দরিদ্রের সবার উপর সমভাবে ফরজ। উভয়ে দিবাভাগে সমভাবে পানাহার, যাবতীয় হারাম কাজ, এমন কিছু হালাল কাজ আছে যা রোজাকে বিনষ্ট করে তা থেকে বিরত থাকে। তাই নীতিগত  ভাবে রোজা মুসলমানদের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের ভাব প্রতিষ্ঠা করে দেয়। অধিকন্তু রোজা ধনীকে দরিদ্রের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল করে তোলে। পানাহার বর্জন করে রোজা রাখার ফলে ধনী লোক অনাহারক্লিষ্ট মানুষের দুঃখ-যাতনা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়। তাই তিনি দুঃস্থের খেদমতে এগিয়ে আসতে আগ্রহশীল হয়ে থাকেন।

____________

বোয়ালিয়া, রাজশাহী

Comments are closed.