ইসলামে নির্দেশ ও নির্দেশনার পার্থক্য: পর্ব-১
সাধারণভাবে মনে করা হয় কোরআন শরীফে স্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হুকুম-আহকামগুলো মুসলমানদের জন্য ফরজ হবে। কোরআনের মতো স্পষ্টভাবে বর্ণিত হাদীসও ফরজ বা ওয়াজিব হবে বলে মনে করা হয়। এক অর্থে এটি সত্য হলেও বিষয়টি ব্যাখ্যার দাবি রাখে। উভয় ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট হুকুম আহকামের অপরিহার্যতা থাকা সত্ত্বেও তা ‘নির্দেশ’ অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ‘নির্দেশনা’ অর্থেও আমলযোগ্য হতে পারে। এ নিবন্ধে নির্দেশ ও নির্দেশনার পার্থক্যের আলোকে সমসাময়িক কতিপয় বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রথম পর্বে কোরআন ও হাদীসের সংশ্লিষ্ট সুস্পষ্ট বর্ণনাগুলোকে নির্দেশ ও নির্দেশনার আলোকে ব্যাখ্যা করে ইসলামী শরিয়াহ’র অন্তর্গত ভাবধারাকে অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে।
কুরআনের আয়াতসমূহের শ্রেণীকরণ:
সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াত অনুসারে কুরআনের আয়াতসমূহ দুই শ্রেণীর। যথা: (১) আয়াতে মুহকাম বা দ্ব্যর্থহীন আয়াত এবং (২) আয়াতে মুতাশাবিহ বা দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, মুহকাম আয়াতসমূহই ‘উম্মুল কুরআন’ তথা কুরআনের ভিত্তি। অর্থাৎ মানবসমাজের অনুসরণের (হেদায়াত) জন্য পবিত্র কুরআনের দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহ যথেষ্ট। বাদবাকী দ্ব্যর্থবোধক (রূপক) আয়াতগুলোর ওপর শুধুমাত্র বিশ্বাস পোষণ করাই যথেষ্ট। সেগুলোর গুঢ় তাৎপর্য অনুসন্ধান প্রচেষ্টাকে ‘ফিতনা’ বা বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে। কেননা উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরআনের মুতাশাবিহ আয়তগুলোর প্রকৃত অর্থ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
নির্দেশ ও নির্দেশনা:
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে মনে হতে পারে যে, পবিত্র কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহ ফরয তথা অবশ্য পালনীয়। এটি সত্য হলেও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন, কুরআনের সূরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে,‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর’। এটি নিঃসন্দেহে একটি মুহকাম আয়াত। আয়াতের বক্তব্য অনুসারে একাকী নামাজ পড়ার কোনো বিধান থাকার কথা নয়। অথচ নারীদের একাকী নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে এবং পুরুষদের প্রয়োজনে একাকী নামাজ পড়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াতে নারীদের লক্ষ করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করো’। অথচ মুহাম্মদ (সা) ও তৎপরবর্তী খলিফাদের সময়ে নারীরা সকল কাজে অংশগ্রহণ করেছে। হযরত সাহল ইবন সা‘দ (রা) জনৈক নারীর বিষয়ে উল্লেখ করেন, যিনি নিজের কৃষি জমিতে গাজরের চাষ করতেন এবং এক প্রকারের খাবার তৈরি করতেন। জুমার নামাজ শেষে তিনি মসজিদে নববীর সামনে সাহাবীদেরকে তা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন (সহীহ আল-বুখারী, ১ম খণ্ড)। এ ধরনের অন্য একটি ঘটনা সহীহ মুসলিমের প্রথম খণ্ডে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। যাতে দেখা যায়, রাসূল (সা) একজন ইদ্দত পালনরত নারীকে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার জন্যে কৃষি কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অনুমতি দিয়েছেন।
এভাবে দেখা যায়, কুরআনের নির্দেশ মাত্রই কাঠামোগতভাবে অবশ্য পালনীয় নির্দেশ বা order নয়। আবার তা ‘নির্দেশ নয়’– এমনও নয়। বরং কুরআনের নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো ইত্যাদি ধরনের নির্দেশসমূহ প্রত্যক্ষভাবে ও পূর্ণ আঙ্গিকে পালনীয়। অপরদিকে ‘তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু করো’ এবং এ ধরনের বাহ্যত নির্দেশমূলক কিছু কিছু আয়াত মূলত নির্দেশনামূলক (directive)। কুরআনের কোন্ আয়াত প্রত্যক্ষ নির্দেশমূলক ও কোন্ আয়াত নির্দেশনামূলক তা নির্ণয় করার জন্য সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিবেচনা করতে হবে।
মূলনীতি ও মডেল:
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, ‘আমি জ্বীন ও মানুষকে আমার ইবাদত ভিন্ন অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করি নাই’। সে হিসেবে একজন মুসলমান ঈমানের বিপরীত নয় এমন যে কোনো কর্মে লিপ্ত হওয়া মানেই ইবাদতে শামিল থাকা। এ দৃষ্টিতে হাদীস শরীফে প্রাকৃতিক কর্মসমূহকেও সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদিকে ‘হক্কুল্লাহ’ বা আল্লাহর হক্ব বলা হয়েছে। এগুলো সাধারণত ইবাদত হিসাবে পরিচিত। অন্যদিকে বৃহত্তর অর্থে ইবাদত হিসাবে গণ্য যে সমস্ত কাজ ‘হক্কুল ইবাদ’ বা সমাজ-সংশ্লিষ্ট সেগুলো ফিকাহর ভাষায় ‘মুয়ামালাত’ হিসাবে চিহ্নিত।
ইবাদতের বিষয়গুলোতে মূলনীতি বা তত্ত্ব ও কাঠামো বা মডেল– এতদুভয়ই হুবহু পালনীয়। কিন্তু মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে মূলনীতিই মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য। প্রস্তাবিত কাঠামো বা মডেল হলো অনুসরণীয় মূলনীতিকে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে উপস্থাপিত। কিছু কিছু মডেলকে তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে হবে। ইসলামে যেসব সামাজিক বিধি-বিধানকে ফরজ করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হলো প্রথম মুখ্য বিবেচনা, সংশ্লিষ্ট কাজের নির্ধারিত চৌহদ্দি হলো দ্বিতীয় মুখ্য বিবেচনা। এতদুভয়ই সম্মিলিতভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের মূলনীতি, তত্ত্ব বা তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে বিবেচিত। মডেল বলতে আমরা যা বুঝি তা যুগোপযোগিতা সাপেক্ষে পরিবর্তনযোগ্য।
পূর্ব-নির্ধারণ বনাম বিচার বিবেচনার স্বাধীনতা:
বিশ্লেষণ পদ্ধতি, বিবেচনাবোধ, চিন্তার কাঠামো, মূল্যবোধ কিম্বা স্বাধীনতার যে কোনো ধারণাই কোনো না কোনোভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত’ কিম্বা ‘সীমায়িত’। এই অর্থে স্বাধীনতার শর্ত হলো মৌলিক কিছু ‘পূর্ব-নির্ধারণ’ (pre-determination)। যার উৎস হিসেবে কেউ ‘প্রকৃতি’কে মানুক বা ঈশ্বরকে মানুক, তাতে মূল বিষয়ের কোনো হেরফের হয় না। প্রকৃতির বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা যায়। একইভাবে ইসলামের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পূর্ব-নির্ধারিত বিষয়গুলোর মধ্যকার সমাজ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর উপযোগিতাও পর্যবেক্ষণ এবং যৌক্তিকতা দিয়ে প্রতিপাদন করা সম্ভব।
ইসলামে কিছু বিষয়কে গাইডলাইন হিসেবে ফিক্সড করে দেয়া হয়েছে। তবে মুয়ামালাতের বিষয়গুলোর প্রয়োগযোগ্যতার বিষয়ে বিচার বিবেচনার এতো বেশি প্রয়োজন রয়েছে যে, এর সাথে কথিত ‘পূর্ণ’ স্বাধীনতার কোনো ফারাক নাই। বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোকে ইসলামের প্রস্তাবনা ও উপস্থাপনাগত দুর্বলতা মনে করা হলে, তা ভুল বিবেচনা হবে। এমনকি একই বিষয়কে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে বিবেচনা করা সত্ত্বেও উভয় সিদ্ধান্ত ও কর্মধারাই সঠিক হতে পারে। বনু কুরায়যার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
পর্ব: