ইচ্ছামতো খরচ বাড়ানোর বাজেট

বিগত দু বছর যাবত আমি বাজেট রিভিউ করে আসছি।এবার এসে বুঝলাম, কেন বিরোধী দল এবং বামপন্থীরা বাজেটের একটা গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এর কারণ হলো, আমাদের বাজেট এতই গতানুগতিক, এতই রাজনৈতিক এবং এতই অনৈতিক যে এর জন্যে বছর বছর নতুন কিছু বলার নাই। এ বাজেটের একটাই বৈশিষ্ট্য। লুটপাটের জন্যে খরচ বাড়াও এবং সেই খরচের বোঝা পরোক্ষ কর বাড়িয়ে জনগণের উপরে চাপিয়ে দাও।

বাজেটের প্রায়োগিক আলোচনায় যাওয়ার আগে, আমাদের দেশের বাজেটসমূহের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরছি।

হীরক রাজার বাজেট

বাজেটের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি একটা “আল্লার মাল, আল্লায় নিয়া গেছে”, “বিরোধী দলের ধাক্কায় রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ছে” এবং “বাংলাদেশেসেকেন্ডও লোড শেডিং নাই” মার্কা একটা হীরক রাজার গালগপ্প। উদ্ধৃতির ভেতরের বাক্যাংশগুলো রূপকার্থে ব্যবহার করছি।

আমাদের পুরো বাজেট প্রক্রিয়াতে আত্মসমালোচনার কোন জায়গা নাই। রানা প্লাজার পরে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগ কমে আসাসহ, প্রেষণ (remittance) কমে আসাসহ অন্য ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে যে কোন ধরনের হুমকি, বিপর্যয়, সমস্যাগুলো বাজেটে প্রতিফলিত হয় না। আমাদের সব কিছু ভালো, সব ঠিকঠাক— দেশ রকেটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সবাই হাতে হীরা পরে, হীরক রাজার দেশের বাজেট হয়— মোটের উপর সরকারিদলের বাজেট বক্তৃতা শোনলে এমনই মনে হয়। বিএনপির আমলেও তাই মনে হত।

বাজেটে ধারাবাহিক মিথ্যাচার

মিথ্যা বলতে কারো লজ্জা লাগে না। এ ধারাবাহিকতা বাজেটে রক্ষিত হয়েছে। বিগত বছরে, ৬.২% প্রবৃদ্ধি দেখাতে সরকার ইচ্ছা মতো, ডাটা শাক রান্না করছে। ইকনমিস্টরা দেখিয়েছেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ৫.৭%-এর বেশি হতে পারে না। অর্থনীতিবিদ, ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিসহ সবাই বলছে ৬.২% প্রবৃদ্ধি ভুয়া।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ২০০৯ সালে, অর্থাৎমুক্তিযুদ্ধের ৩৮ বছরে প্রতিবছর আমাদের মাথাপিছু আয় হয়েছে ৮৪৩ ডলার।

কিন্তু পরের দুই বছরে শেয়ার মার্কেটে বাড়ি খেয়ে মধ্যবিত্তের আয়-রোজগার দেশের অল্প কিছু লোকের হাতে গিয়ে, আবাসন সেক্টর ধ্বসে, ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে এবং তার পরে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের চাপে কৃষি উৎপাদনের মূল্য হ্রাস পেয়ে, গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বসে পড়ার পরেও— শুধু মাত্র রেমিটেন্স এবং পোষাক শিল্পের রফতানি বৃদ্ধি দেখিয়ে সরকার, দুই বছরে আমাদের দেশের গড় মাথাপিছু আয় দেখাচ্ছে ১১৯০ ডলার। তার মানে সব চেয়ে খারাপ সময়টাতে মানুষের গড় আয়, ১১৯০-৮৪৩ = ৩৪৭ ডলার, মানে ২৬৭১৯ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে!

এর মানে বাংলাদেশের পরিবার প্রতি আয়, সরকারি হিসেবে গড়ে ৪.২ জন উপার্জনকারী হিসেব করে, এ ৪ বছরে, গড়ে প্রতি পরিবারে বৃদ্ধি পেয়েছে ১ লক্ষ ৬ হাজার টাকা।

১৯৭১ সালের পরে ৩৭ বছরে আমরা ৮৪৩ ডলারে পৌঁছিয়েছি আর সরকারি হিসেবে মাত্র ৪ বছরে সেটির ৪১% বৃদ্ধি হয়েছে।

এ রকম সীমাহীন মিথ্যা কথা এ বাজেটের পরতে পরতে লেখা আছে। যেমন ২৫ হাজারকিলোমিটার নতুন রাস্তা বানানো হয়েছে, দেড় লক্ষ মিটার ব্রিজ বানানো হয়েছে। এসব পড়তে গেলে হাসতে হাসতে পেটের খিল ধরে যায়।

গোয়েবলসের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, সে একই মিথ্যা কথা বার বার বলত। কিন্তু, সেই মিথ্যাকে সবাই মিলে ধরিয়ে দিলে লজ্জা পেতেন। কিন্তু, আমাদের সরকারগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লজ্জাহীনতা। এরা সেই কাকের মতো যে মনে করে, চোখ বন্ধ করে থাকলে কেউ তার চুরি দেখতে পারবে না।

ইচ্ছামতো খরচ বাড়ানোর বাজেট

এ কথা আগেও বলেছি। আমাদের সরকারগুলোর গণচরিত্র সবার জানা। আমাদের দেশের মানুষের কোন ধরনের আত্মরক্ষার উপায় নাই। সরকার জনগণকে কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা দেয় না। উন্নত দেশে যারা থাকেন, তারা জানেন, অনেক দেশে চাকরি না থাকলে সরকার বসে খাওয়ায়, কোথাও আছে চিকিৎসা ফ্রি, কোথাও শিক্ষা ফ্রি। কোন টাল্টি-বাল্টি নাই।

কিন্তু, আমাদের দেশে কিছুই ফ্রি না। সব কিছুরই পয়সা দিতে হয়। কিন্তু, তারপরেও আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশের সকল ধরনের বাৎসরিক উৎপাদন এবং খরচ যার ভিত্তিতে জিডিপি হিসাব হয়, তার ১৮.৩% খরচ সরকার নিজে করে। এর মানে, আমাদের সরকার জিডিপির বড় একটা অংশ দখল করে। আলটিমেটলি সরকার উৎপাদন বলে তেমন কিছু করে না। ফলে খরচটাই জিডিপিতে ঢুকে। এটি আবার কেউ-না কেউ বিক্রি করে।

এ সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা প্রতি বছর ব্যাপক হারে খরচ বাড়াচ্ছে। সেই খরচের চাপ এরা জনগণের উপর কর হিসেবে তুলে দিছে।

এবার আরো গোদের উপর বিষফোঁড়া হলো, উপার্জন কম হওয়াতে সরকার ঋণ করা শুরু করছে। এখন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ বেশি পায় নাই ফলে, দেশিঋণ নেয়া শুরু করছে।

বিগত বছরে, সরকারের ঘাটতি ছিল, ৫%। মানে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরে এটি ছিল, ৫৫,০০০ কোটি টাকা, এবং ২০১১তে ছিল ৫২,০০০ কোটি টাকা, মানে তিন বছরে এটি পৌঁছেছে ১৬৬, কোটি টাকায়। এর ফলে, মাত্র তিন বছরে দেশের প্রতিটা মানুষের উপরে ১০,০০০ টাকা ঋণের বোঝা চাপিয়েছে সরকার । যার দায় আমাদেরকে বছরের পর বছর পুষতে হবে।

সরকার কিভাবে প্রতি বছর বাজেটে এ খরচটা বাড়াচ্ছেএকটু দেখা যাক:

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *