আমরা কেন রোজা রাখব?

(Re-edited, repeat post)

আমরা কেন রোজা রাখব? 
এ প্রশ্ন অনেকেই করতে পারেন আর মুসলিমদের অনেকেই এর উত্তরে হয়তবা বলবেন এতে অনেক পুণ্য অর্জন হয় যা আখিরাতে কাজে লাগবে। আর কেউ হয়তবা বলবেন রোজা রাখলে শরীরের ওজন কমবে, স্বাস্থ্যগত উপকার হবে এবং অভুক্ত থাকলে গরীবের কষ্টের অনুভূতি জাগবে ইত্যাদি । রোজা রাখলে এসব উপকার অবশ্যই হবে কিন্তু যিনি এ রোজা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে কি বলেন দেখা যাক। সুরা বাকারায় এ বিষয়ে আল্লাহ এভাবে বলেন যে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“ হে বিশ্বাসীরা, তোমাদের প্রতি সিয়াম (রোজা)রাখার হুকুম করা হয়েছে যে ভাবে হুকুম করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।“ (২:১৮৩)

তাকওয়া সম্পর্কে ইসলামী স্কলাররা অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক কথায় তাকওয়ার অর্থ বলা যায় মানুষের সকল কর্মে ও কাজে তার মনে আল্লাহ-অনুভুতি বা সচেতনতা (God consciousness) সজাগ থাকা। তাকওয়া হল আল্লাহ-সচেতনতার এমন এক মানসিক অবস্থা যা পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সদাসর্বদা প্রেরণা জোগায় উত্তম কাজের। যে মানুষের মনে সর্বদা তাকওয়া সজাগ থাকবে তার পক্ষে কোন অন্যায় কাজ করা বা খোদার নির্দেশ অমান্য করা সহজ হবেনা কেননা তার বিবেক বাধা দিবে। তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ নয়,বরং সর্ব প্রকার জৈবিক,আত্মীক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি।  তাই রমজান বা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই তাকওয়া অর্জন। একজন রোজাদার প্রকাশ্যে রোজা আছি বলে গোপনে আহার বা পান করার সুযোগ থাকলেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে সে তা করেনা আর এজন্য আল্লাহ বলেন সিয়াম হচ্ছে একজন ঈমানদারের এমন এক এবাদত যা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এখানে “লোক দেখান এবাদতের” কোন অবকাশ নাই। রোজার সত্যিকার মর্ম বুঝাতে ইমাম গাজ্জালির ব্যাখ্যা পড়তে পারেন এই লিংক থেকে।

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় আজ ইসলামী  জ্ঞানার্জনের দায়ভার চাপানো হয়েছে স্রেফ মসজিদের ইমাম বা মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপর। জ্ঞানার্জন যে প্রতিটি মুসলমান নরনারীর উপর ফরয সেটি মুসলিমদেরকে  ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে।  ফলে প্রচণ্ড ভ্রষ্টতা বেড়েছে ইবাদতে। রোযা রেখে দোকানে বসে যে ব্যক্তিটি দ্রব্যমূল্য বাড়ায় বা পণ্যে ভেজাল মেশায় বা অফিসে বসে ঘুষ খায় এমন ব্যক্তি যে তাকওয়াশূণ্য এবং রোযা থেকে কোন কিছুই লাভ করেনি তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? সে তো পথভ্রষ্টতার পথ বেছে নিয়েছে। এখানে কাজ করছে তার অজ্ঞতা। রোযা তার কাছে নিছক উপবাস ছাড়া কি অন্য কিছু উপহার দিয়েছে? অথচ তাকওয়া-সম্পন্ন ব্যক্তির অদম্য অনুপ্রেরণা হলো,প্রতি মুহুর্তে সৎপথে চলার। সর্ব মুহুর্তে তাঁর সতর্কতা হলো সর্বপ্রকার হারাম কাজ থেকে দূরে থাকার। যার মনে সে সতর্কতা নাই,বুঝতে হবে তার মনে তাকওয়াও নাই।

টরন্টো ইসলামিক ইন্সটিটিউটের (IIT) ইমাম শেখ আহমেদ কুট্টি বলেন যারা রোজা অবস্থায়  দাঁতের মাজন, টুথ পেইষ্ট ও টুথ পাউডার ব্যবহার করা হারাম বা মকরুহ বলেন তাঁরা যে রোজার আসল উদ্দেশ্য কি তা বুঝতে অপারগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  মানুষ টুথপেইষ্ট ব্যবহার করে দাঁত পরিষ্কার করা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়। দীর্ঘ সময় কিছু না খেলে মুখে গন্ধ হওয়া স্বাভাবিক এবং তা দূর করতে টুথপেইষ্ট ও টুথব্রাশ ব্যবহারের বিকল্প নেই। পশ্চিমা দেশে মুসলিমরা যেথায় রোজা রেখে  অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে কাজ করেন তাদের বেলায় এ ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রোজার মাসে কোরআন তেলায়ত
রমজান মাসে যে কোরআন নাজিল হয়েছে একথা কোরআনেই উল্লেখ আছে। বলা হয় রোজার মাসে কোরআন তেলায়ত অনেক পুণ্যের কাজ তাই কোরআন না বুঝে হলেও যে যত বেশী তেলায়ত করবে তত বেশী সওয়াব হবে। কোরআন আল্লাহর কালাম এতে অবশ্যই দৈবী কানেকশান আছে তাই তা না বুঝে পড়লে মনে প্রশান্তি আসতে পারে এবং সাওয়াব কামাই হতে পারে। এখানে এই ‍“দৈবী কানেকশান” কথাটার একটি বিশেষ তাৎপর্য রাখে যা একটু পরে আলাপ করব তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে কোরআন কি না বুঝে পড়লেই মুসলিম হিসাবে আমাদের দায়িত্ব পুরন হবে? কেfরআন কি না বুঝে পড়ার জন্য নাজিল হয়েছে? আসুন দেখি কোরআন যিনি নাজিল করেছেন তিনি কি বলেন?
আল্লাহ বলেন, “… রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।“ (সুরা ২:১৮৫)
তাহলে দেখা যায় কোরআন এসেছে মানুষকে সত্য ও সঠিক পথ পদর্শন করতে। এখন প্রশ্ন হল কোরআন না বুঝে পড়লে  আমরা সৎপথের সন্ধান পাব কীভাবে?
ইমাম কারতাবী (র:) “আল্ জামি লি আহ্কাম আল কোরআন (al-Jami’ li ahkam al-Qur’an)  অর্থাৎ “কোরআন তেলায়ত করা বা পড়ার এটিকেট তথা আদব ” সম্পর্কে বলতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসরণ করতে  বলেছেন। তিনি বলেন, কোরআন তেলায়ত হতে হবে

  • ১) তাজওয়িদ ও
  • ২) তাতাব্বুর করে।

অর্থাৎ সহিহ বা শুদ্ধ ভাবে এবং প্রতিটি আয়াতের অর্থ বুঝতে বা উপলব্ধি করতে মন এবং চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

কোরআন আসলেই এক বিস্ময়কর গ্রন্থ এর ভাষার মাধুর্য এবং শব্দ চয়নও অদ্ভুত লাগে! আর আরবী ভাষাভাষীদের কাছে আরবী ভাষার অলৌকিকত্ব উপলব্ধি হয় কোরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে। প্রখ্যাত ইসলামী স্কলার ড: আব্দুল্লাহ হাকিম সে দিন জুম্মার খোতবায় একটা উদাহরণ দিয়ে এ ব্যাপারটা উপলব্ধির কথা বলেন। সুরা বাকারা আমরা অনেকেই পড়েছি। এই সুরার প্রথম আয়াতেই আল্লাহ কোরআন যে তার প্রদত্ত গ্রন্থ তা বলতে গিয়ে বলেছেন “এতে কোন সন্দেহ নাই” কিন্তু এখানে আরবী বাক্যটা আল্লাহ যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা লক্ষ্য করলে অবাক হতে হয়! যারা আরবী শিখার পাঠ নিয়েছেন সবাই জানেন আরবীতে কোন কাছের জিনিস যেমন “এটা একটি পুস্তক” এর অনুবাদ হবে “হাঝা কিতাবুন” আর দূরের কিছুকে বলতে বলা হয় ঝালিকা যেমন “ঐ চাঁদ” কে বুঝাতে বলা হবে “ঝালিকা কামুরুন” এটাই আরবী ভাষার নিয়ম কিন্তু যে কোরআন আমাদের হাতে রেখে তেলায়ত করছি সেখানে হাঝা কিতাবুন না বলে আল্লাহ কেন  ঝালিকাল কিতাবু ব্যবহার করলেন সুরা বাকারার সেই প্রথম আয়াতে? এক জন আরবের কাছে এটা বুঝতে বেগ পেতে হবে না এ জন্য যে যদিও কোরআন তাঁর হাতে কিন্তু এটা আসলে আসছে ঐ দূরে আল্লাহর আরশ থেকে অর্থাৎ এখানে দৈবিক কানেকশনের ব্যাপার । তাই এ কিতাব না বলে বলা হয়েছে এ সেই  কিতাব তাই এজন্য ঝালিকা বলা হয়েছে। আসলে কোরআনের সঠিক ভাব ও অর্থ বুঝা এক মাত্র আরবী ভাষায়ই সম্ভব। পৃথিবীর অন্য কোন ভাষা সেরকম সমৃদ্ধ নয় যে কোরআনের একশত ভাগ ভাব প্রকাশে সক্ষম!

উপসংহারে  বলতে চা্ই, রমজান সম্পর্কে আমার এক বন্ধু খুবই সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন,

রমজান মাসকে শুধু পুণ্য অর্জনের মাস হিসাবে না ভেবে প্রশিক্ষণের মাসও বলা দরকার। আর এ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে জীবনের সকল অবস্থায় আল্লাহর হুকুম পালন করার সফলতা অর্জন করার ট্রেনিং। যে এই প্রশিক্ষণে সফলকাম সে  আসলই  ভাগ্যবান। কেননা মনে রাখতে হবে পুণ্য অর্জনে একসময় শয়তানের পাল্লা অনেক ভারী ছিল কিন্তু আল্লাহর একটি হুকুম পালন না করায় সে এখন অভিশপ্ত তার শেষ ঠিকানা হবে জাহান্নাম যা আল্লাহ কোরআনে একাধিকার উল্লেখ করেছেন।”

রমজান মাস অতিবাহিত করলাম অথচ বাকী জীবনে আল্লাহর হুকুম পালন করলাম না, মিথ্যা ও অন্যায়ের সাথী হলাম, নিজেকে পাপ পঙ্কিলতা থেকে দূরে রাখতে পরলাম না তার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ব্যর্থতা থেকে দূরে থাকার তৌফিক দেন। আমীন।

 উস্তাদ নোমান আলী খানের Welcome Ramadan 2017 – Lecture টি শুনতে পারেন , এখানে চিন্তার খোরাক জাগানো বেশ কিছু কথা আছে।

পরিশেষে চাঁদ দেখা নিয়ে মুসলিম সমাজে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশের মুসলিমদের মাঝে প্রতি বছর যে মতানৈক্য দেখা দেয় তা বড়ই দু:খের ব্যাপার। মহাকাশে চাঁদ নামের উপগ্রহ তো একটি আর আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানে তাঁর বান্দাদের জন্য বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে সে গ্রহের গতিবিধি জানার এখন কোন সমস্যা নাই। বিশেষ করে আধুনিক এস্ট্রোনমী এত অগ্রগতি হয়েছে যে পৃথিবী থেকে চাঁদের চেয়েও দূরত্বের অনেক গ্রহের খবর এখন বিজ্ঞানের নখদর্পণ বললে ভুল হবে না। চাঁদ দেখে রোজা রাখার কথা আল্লাহর রাসুল (স:) বলেছেন যাতে চাঁদের জন্মের ব্যপ্যারে নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে বিজ্ঞানের মাধ্যমে যদি এটা নিশ্চিত করা যায় তাহলে অসুবিধা কোথায়? এ বিষয়ে ফিকাহ কাউন্সিলের মতামত অনেকেই গ্রহণ করছেন তবে পাকিস্তানি ও ভারতীয় ইমামদের পরিচালিত হেলাল কমিটির প্রভাবিত কিছু মসজিদের ছাড়া সবাই এখন তা অনুসরণ করছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নর্থ আমেরিকান ফিকাহ কাউন্সিলের ওয়েব সাইটে অনেক তথ্য পাবেন। এ লিংক দেখুন এবং নিচের ভিডিও ক্লিপটাও শুনার অনুরোধ করব

এই চাঁদ দেখার বিষয়ে একটি আলাদা ব্লগ এখানে  আছে পড়তে পারেন। পক্ষে বিপক্ষের বিভিন্ন মতের মন্তব্য আছে।


Comments

আমরা কেন রোজা রাখব? — 2 Comments

  1. একটি সুন্দর পোস্ট করেছেন। বলেছেন, “সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই তাকওয়া অর্জন।” হ্যাঁ, এটাই আসল কথা। মানুষ জাগতিক ইন্দ্রজাল থেকে বাঁচিয়ে চলতে নিজেদেরকে প্রকৃতিস্থ করার প্রয়াস। একদিকে এই কণ্টকাকীর্ণ জগত তাদেরকে আবদ্ধ করতে চাইবে আর তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলবে। এই বাঁচানোর প্রয়াসের নামই হচ্ছে তাকওয়া। একবার ওমর (রা.) উবাই বিন কা’ব (রা.)কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উবাই (রা.) ওমর (রা.)কে বললেন, ‘আপনি কি কখনো কণ্টক ঘেরা পথ দিয়ে হেঁটেছেন?’ ওমর বললেন, ‘জী, হেঁটেছি।’ উবাই (রা.) বললেন, ‘তখন আপনি কি করেছেন?’ ওমর (রা.)বললেন, ‘আমি আমার আস্তিন এঁটে সতর্ক হয়ে চলেছি (যাতে কাটা না বিধে)।’ উবাই বললেন, ওটাই ‘তাকওয়া’। অর্থাৎ সেই সর্তকতা অবলম্বন।

  2. মুত্তাকীদের (তাকওয়া অর্জনকারী) পরিচয় আল্লাহ তাঁর কোরআনের এক আয়াতে বর্ণনা করেছেন:
    ”সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই হল মুত্তাকী।”
    (সুরা: ২: ১৭৭)

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *