অবরুদ্ধ কাতার, সৌদি জোটের ভুল সমীকরণ -ডেভিড হার্স্ট

[অনলাইন ভিত্তিক প্রসিদ্ধ সংবাদ মাধ্যম ‘আরবি ২১ ডট কম’ এ ৮ ই জুন  “কাতারকে অবরুদ্ধ করার হিসাব-নিকাশ কি ব্যর্থ হবে?” শিরোনামে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিশ্লেষক David Hirst এর লেখা। অনুবাদ ও পরিমার্জনা করেছেন মুহাম্মদ নোমান]

এটা অনেক পূর্ব থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আইএস এবং আল কায়দাকে দমন করা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রকৃত লক্ষ্য নয়; বরং সন্ত্রাস দমন ইস্যুটি অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সারির লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্বশক্তি ও স্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই মৌলিক কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের উপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের যে অপচেষ্টা করা হচ্ছে তা থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রকৃত অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উপসাগরীয় এলাকা থেকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির প্রস্থান প্রচেষ্টাই মূলতঃ স্থানীয় রাষ্ট্রগুলোর ঔদ্ধত্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা যে কোন মূল্যে পশ্চিমাদের ছেড়ে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ করতে চায়।

মোট কথা, তিনটি স্থানীয় শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের দখল নিতে মরিয়া।

এক।  ইরানের নেতৃত্বাধীন শিয়া শক্তি। এই গ্রুপে ইরানের সাথে রয়েছে সিরিয়া, ইরাক এবং হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ।

দুই।  উপসাগরীয় অঞ্চলের স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শক্তি। এই ব্লকের রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে – সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, জর্ডান এবং মিসর।

তিন।  অত্র অঞ্চলের পরিবর্তনকামী শক্তি। এই ব্লকের নেতৃত্বে রয়েছে তুরস্ক এবং কাতার, আরা তাদের সাথে রয়েছে ইখওয়ানুল মুসলিমীন, হামাসসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গ্রুপগুলো এবং আরব বিপ্লবের পক্ষের শক্তিগুলো।

এই ত্রি-শক্তির উত্তপ্ত প্রতিযোগিতার কারণে উপসাগরীয় অঞ্চলসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠেছে অশান্ত। এই বিশৃঙ্খলার জন্য আমেরিকার শত্রুদের পাশাপাশি তার মিত্ররাও সমানভাবে দায়ী। এর সবচে বড় প্রমাণ হচ্ছে কাতারের বিরুদ্ধে সাউদী জোটের সাঁড়াশি আক্রমন।

কাতারের উপর অবৈধ বল প্রয়োগ করে নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়ার হিসাব নিকাশে সাউদী জোট মারাত্মক ভুল করেছে। তারা মনে করেছিল কাতারের মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে হজম করতে তাদের খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা উপসাগরীয় জোটের ঐক্যের ভীতকেই চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর ঐক্যই এতদিন পর্যন্ত ইরানী প্রভাব মোকাবেলা করে আসছিলো। কিন্তু সৌদি –আমিরাতের অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ তাদের পরস্পরের ঐক্যে যে চিড় ধরিয়েছে এবং তাদের আস্থায় যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে তা এই অঞ্চলে ইরানী প্রভাবকে আরও বেশী জোরদার করবে।

অন্যভাবে বলতে গেলে, ইরাক সিরিয়ায় ক্রমবর্ধমান ইরানী প্রভাব সৌদি এবং তুর্কি এই দুই ব্লককে যেভাবে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল এখন কাতারের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব ঠিক তার বিপরীত ফল বয়ে আনবে। বরং এমনও হতে পারে যে, এই ঘটনা তুরস্ক, ইরান এবং এই অঞ্চলের সুন্নি ইসলামিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। যদি তা বাস্তবে ঘটে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে এই দুই শক্তির মধ্যে স্থায়ী মৈত্রী প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। বরং পরিস্থিতির চাপ উভয়ের মধ্যে অস্থায়ী এবং দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকেন্দ্রিক মৈত্রী তৈরি করতে পারে। তার আলামত ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। কাতারের উপর অবরোধ ঘোষণার পরপরই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারীফ তুরস্কে ছুটে যান এবং এরদোগানের সাথে সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

সৌদি আরব, আমিরাত, বাহরাইন এবং মিসর অবরোধ আরোপ করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনি এরই মধ্যে দুটি ঘটনা খেলার চক পাল্টে দেয় এবং কাতারের বিরুদ্ধে তাদের হামলার তীব্রতাকে চরমভাবে ব্যাহত কর।

প্রথমতঃ সৌদি – আমিরাতের মতি গতি বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাতারে সৈন্য প্রেরণের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্দেশে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যেই তুরস্ক সরকার পার্লামেন্টের জরুরী অধিবশন ডেকে সৈন্য প্রেরণ সংক্রান্ত বিল পাশ করে।

দ্বিতীয়তঃ বুধবার ইরানের পার্লামেন্ট ভবন এবং খোমাইনির মাজারে জোড়া হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়। ঘটনার দায়িত্ব আইএস স্বীকার করলেও ইরান এর জন্য সরাসরি সৌদি আরবকে দায়ী করে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধ গ্রহন করার হুমকি দেয়।

ইরানী হুমকিকে সৌদি আরব খুব গুরুত্বের সাথে নেয়। এর প্রমাণ বিপ্লবী গার্ডের হুমকির পর সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার পেছনে নিজেদের হাত থাকার কথা জোরালভাবে অস্বীকার করেন।

একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি বড় শক্তির সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দেশটির জন্য স্বস্তিদায়ক সংবাদ নয়। বরং উল্টা তাকেই অবরুদ্ধ করে তুলতে পারে। সৌদি আরবের পক্ষে ক্ষুদ্র কোন রাষ্ট্রকে বশ করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু বিশ্বশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া বড় কোন শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তাদের মোটেও নেই।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব শক্তিগুলো সামরিক দিক দিয়ে কতোটা দুর্বল তার একটা উদাহরণ হচ্ছে ইয়ামেন যুদ্ধ। তিন বছর ধরে তারা সেখানে হাউছি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ফলাফল শুন্য। হাউছিদের মতো একটা মিলিশিয়া গ্রুপের বিরুদ্ধে যারা তিন বছরেও বিজয় লাভ করতে পারেনা তাদের সামরিক সক্ষমতা কতোটুকু তা সহজেই অনুমেয়।

এখানে আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষ্যনীয়। সংকটের শুরু থেকেই মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আসতে থাকে। ৫ ই জুন সৌদি জোটের পক্ষ থেকে কাতারের উপর অবরোধ আরোপের ঘোষণার পর প্রায় সাথে সাথেই পেন্টাগন কাতারকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করে। “কাতার এই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে” বলে পেন্টাগন কাতারের প্রশংসা করে। বক্তব্যে কাতারে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি ‘আল উদায়দ’ এর কথা উল্লেখ করে বলা হয় – “সামরিক ঘাঁটির কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে”। পেন্টাগনের এই বক্তব্যকে কাতারের পক্ষে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছিলো। এর পর ট্রাম্পের টুইট বার্তা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে। পরপর কয়েকটি টুইটের মাধ্যমে তিনি এই বার্তা পৌঁছাতে চেষ্টা করেন যে, তার ইশারা এবং সম্মতিতেই কাতারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং তিনি দাবী করেন যে, কিছুদিন পূর্বে রিয়াদে শেষ হওয়া আমেরিকান ইসলামিক সম্মেলনের প্রচেষ্টা কাঙ্খিত ফলাফল বয়ে আনছে। দৃশ্যতই তার এই বক্তব্য সৌদি জোটের জন্য উৎসাহব্যাঞ্জক ছিল। ট্রাম্পের এই টুইটের পর পেন্টাগন পুনরায় কাতারকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করে। ইউরোপও পেন্টাগনের সাথে সুর মেলায়। তারা আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান খুঁজে বের করার প্রতি তাগিদ দেয়। এতে তারা দৃশ্যত কাতারের বিরুদ্ধে গৃহীত অবরোধ প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। শুধু তাই নয়, কোনকোন রাষ্ট্র এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল খুব চড়া সুরে বলেন- “এটা খুবই স্পষ্ট যে, কাতারকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা এবং দেশটির অস্তিত্বকে চরমভাবে হুমকির মুখে ফেলাই উদ্দেশ্য। এই ধরণের ‘ট্রাম্পীয় সমাধান’ চতুরমুখি সমস্যায় জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য খুবই ভয়ংকর।”

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল জুবায়ের অবরোধ আরোপের দিনই ইউরোপে দৌড়ে যান তাদের পদক্ষেপের প্রতি ইউরোপের সমর্থন লাভের আশায়। ইউরোপিয়ানদের প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন নি। পরে তিনি আসল কথা পাড়েন যে, ট্রাম্পের ইশারায় তা করা হয়েছে। এইটা তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপিয়ানরা ট্রাম্পের নাম শুনতেই ক্ষেপে যায়। তাই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোঁচা মেরে বলেন যে, “ট্রাম্পীয় সমাধান” কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না।

তবে মার্কিন প্রশাসনের ধোঁয়াশা বেশীক্ষণ থাকেনি। তুরস্কের সৈন্য প্রেরণের ঘোষণা ট্রাম্পের চৈতন্য ফিরিয়ে আনে। তুর্কি পার্লামেন্টে বিল তোলার সাথে সাথেই ট্রাম্প তড়িঘড়ি করে কাতারের আমীর শায়খ তামিম বিন হামাদের সাথে ফোনে আলাপ করে নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে সমস্যর সমাধান করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। প্রয়োজনে সব পক্ষকে সাথে নিয়ে হোয়াইট হাউজে বসারও প্রতিশ্রুতি দেয়। মনে হয়েছে যেন, টুইটের ২৪ ঘণ্টা পরে তাঁর কাছে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের বার্তা পৌঁছে।

আমেরিকায় ট্রাম্পের এমন বালখিল্যতার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠে। একজন মার্কিন রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ট্রাম্পকে উপহাস করে লেখেন- “মনে হচ্ছে কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির কথা ট্রাম্প জানেন না”

নিশ্চিতভাবে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত তাদের ক্ষুদ্র মুখে এতো বেশী পরিমাণ খাদ্য পুরে নিয়েছে যে তা চিবানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করার ক্ষেত্রে তাদের ভুল হিসাব-নিকাশ বুমেরাং হতে বাধ্য। উল্টো তারাই মুসিবতে পড়বে।

তাদের প্রথম ভুল-  ট্রাম্পের কথাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা। তারা যখন ট্রাম্পের ঝুলিতে সাড়ে চারশো বিলিয়ন ডলার রাখছিল তখন ট্রাম্পের আশেপাশের পরিবেশটা একটু তাদের দেখে নেয়া উচিত ছিল। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত ট্রাম্পের তরী যে দ্রুত ডুবছে তা তাদের বুঝা উচিত ছিল। মার্কিন জনমতের চাপে এখন তিনি দিশেহারা। মার্কিন প্রশাসনের উপর খুব দ্রুত প্রভাব হারাচ্ছেন। সিআইএ, এফবিআই, পেন্টাগন, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, সিনেট, কংগ্রেস এবং বিচার বিভাগসহ প্রায় প্রত্যেকটি বিভাবগের সাথে তিনি বিরোধে জড়িয়েছেন। গতকাল ট্রাম্পের বরখাস্তকৃত সাবেক এফবিআই প্রধান James Comey সিনেটে ট্রাম্পকে মিথ্যাবাদী আখ্যায়িত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হাত থাকার কথা জোর দিয়ে বলেন। এই ঘটনার জের ধরে নিকট ভবিষ্যতে ট্রাম্প ক্ষমতাচ্যুতও হতে পারেন। কারণ এই ঘটনা যদি আরও জোরালো ভাবে প্রমাণিত হয় তাহলে তা ওয়াটারগেটের চেয়েও বড় আকার ধারণ করবে নিঃসন্দেহে। অতএব, এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে যে তাদের জন্য খুব বেশী কিছু করা সম্ভব নয় এই সহজ কথাটি সৌদি জোটের বোঝা উচিত ছিল।

এর পরে আসছে আমেরিকায় আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল উতাইবার কথা। প্রায়ই আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয় লোকটি। আমেরিকায় চরম ডানপন্থী ইহুদী লবিগুলোর সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটসের মতো ব্যক্তিকেও পকেটে পুরতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার এই সাফল্য তাকে আরও বেশী বেপরোয়া ও অপরিণামদর্শী করে তোলে। সে মনে করেছিল গেটসের মতো গোটা মার্কিন প্রশাসনকেও বাগে আনা তার পক্ষে সম্ভব হবে। এখানেই সে ভুল করে বসে। মার্কিন রাজনীতির সূক্ষ্মপাঠগুলো বোঝা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ২০০৮ পর্যন্ত আমেরিকায় দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত Sergey Kislyak কে ওয়াশিংটনে এযাবতকালের সবচে বেশী প্রভাবশালী বিদেশি কূটনীতিক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমেরিকানরা তাকে মাটিতে নামিয়ে আনে তার মাত্রাতিরিক্ত ঔদ্ধত্যের কারণে। এইসব রাষ্ট্রগুলোর একটাই সমস্যা, তারা ব্যক্তিগত কিছু প্রভাব এবং দুয়েকটি মার্কিন লবির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারাকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাথে মিলিয়ে ফেলে। অথচ, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

ইউসুফ আল উতাইবার কথা উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, এই লোকটি তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে কাতারের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার চেষ্টা করে। কাতারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উস্কানি মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কাতারের মার্কিন ঘাঁটি প্রত্যাহার করার জন্য লবিং করে। এমনকি তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানেও নিজের হাত থাকার কথা স্বীকার করে। এসব অপকর্মে সে ইসরাইলপন্থি লবিগুলোকে ব্যাবহার করে। চলতি মাসের তিন তারিখ একটি রাশিয়ান হ্যাকার গ্রুপ তার ইমেইল হ্যাক করে প্রায় পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার মতো তার ইমেইল বার্তা ফাঁস করে। এই সব তথ্য তার ইমেইল বার্তায় উঠে আসে। আরব আমিরাত তার কোনটিই অস্বীকার করতে পারেনি।

সৌদি জোটের দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে- কাতারকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মনে করা। তাদের ধারণা ছিল এই ছোট্ট রাষ্ট্রটিকে সহজেই হজম করা যাবে। বড় কোন রাষ্ট্র তার সাহায্যে তেমন এগিয়ে আসবে না। তুরস্কের কথা যে তাদের মাথায় ছিল না তা নয়, তুরস্ককে নিয়ে তাদের ভিন্ন হিসাব ছিল। শেষ দিকে এসে সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত তুরস্কে বেশ মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করে। তারা মনে করেছিল এর দ্বারা তারা তুরস্ককে কিনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এরদোগান একটু মৃদু-মন্দ প্রতিক্রিয়া দেখালেও নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তেমন কোন কড়া অবস্থান নিবেনা। কিন্তু তাদের হিসাব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারণ এরদোগানের বুঝতে কষ্ট হয়নি যে, যদি কাতারের পতন ঘটে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়বে। তাই তিনি কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। দ্রুত সৈন্য প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন।

এখানে এই কথাটি স্পষ্ট করা জরুরী যে, তুরস্কের সৈন্য প্রেরণের অর্থ সৌদি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা নয়। তুরস্ক প্রাথমিকভাবে ৫০০০ সৈন্য প্রেরণের ঘোষণা দিয়েছে। এই পরিমাণ সৈন্য দিয়ে লড়াই করা সম্ভব নয়। এখানে তুরস্কের ম্যাসেজটি সামরিক নয়; বরং রাজনৈতিক। তুরস্ক বোঝাতে চেয়েছে যে, যেকোনো প্রতিকুল পরিস্থিতিতে তারা কাতারের পাশে থাকবে। কাতার তাদের সংকটে একা নয়। পাশাপাশি সৌদি আরবের শাসকদের প্রতি তিনি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। কারণ বাদশা সালমান যদিও সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক, কিন্তু এইসব কর্মকাণ্ডের পেছনে তাঁর ছেলে মুহাম্মাদ বিন সালমানের হাত বেশী। মুহাম্মাদ হচ্ছে অনভিজ্ঞ আবেগি একজন তরুন। তার উপর আবুধাবির শায়খ মুহাম্মাদ বিন জায়দ তার মাথাটা পুরাই নষ্ট করেছে। এই সব বিশৃঙ্খলার পেছনে এই দুই জনের সক্রিয় হাত। কাতার যদি শেষ পর্যন্ত বশ্যতা স্বীকার না করে তাহলে তারা সামরিক আগ্রাসনের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এধরণের কোন চিন্তা যেন মাথায় আনার সাহস না পায় সে জন্য তুরস্কের এই সিদ্ধান্ত।

তাদের তৃতীয় ভুল- তারা তাদের গোপন উদ্দেশ্য লুকাতে পারেনি। কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে মদদ দেয়া এবং ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ধাপ্পাবাজি। এগুলো যে আসল কারণ নয় তা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ যে ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে তারা কাতারকে শায়েস্তা করতে চায় সেই ইরানের সাথে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশরসহ অবরোধ আরোপকারী প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের কূটনীতিক সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরব আমিরাতই ইরানের সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক অংশীদার। আমিরাতের দাবী অনুযায়ী তাদের তিনটি দ্বীপ এখনও ইরান দখল করে রেখেছে। তাহলে তো সবার আগে আমিরাতের উচিত ইরানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

অতএব, মুখে তারা যা বলছে তা তাদের আসল অভিযোগ নয়। তাদের আসল দাবী ভিন্ন, যেগুলো তারা কুয়েতের আমিরের মাধ্যমে কাতারের কাছে পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ইখওয়ানের এবং হামাসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজীরা বন্ধ করে দেয়া। আরবি ভাষায় প্রকাশিত বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের অর্থায়ন বন্ধ করা, যেমন, ‘আরবি ২১’ ‘আল কুদস আল আরাবি’ ‘হাফিংটন পোষ্ট’ (আরবি সংস্করণ) ইত্যাদি। পাশাপাশি বিখ্যাত আরব চিন্তাবিদ আযমি বাশশারাকে কাতার থেকে বহিস্কার করা।

মধ্যপ্রাচ্যের এইসব স্বৈরশাসকগুলো জনগণের স্বাধীন মতপ্রকাশের শেষ মাধ্যমটুকুও কেড়ে নিতে চায়। এই সব গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রচারিত হয় তা তাদের জনগণের ঘুম ভেঙ্গে দিক তা তারা চায় না। তারা তাদের দেশের জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে তো গলা টিপে হত্যা করেছে, কিন্তু তাতেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছেনা। এখন তারা তাদের সীমানার বাইরের গণমাধ্যমগুলোর টুটি চেপে ধরতে চায়। তাদের মসনদ টিকিয়ে রাখতে হলে এসব বেয়াড়া গণমাধ্যমগুলোর লাগাম অবশ্যই টেনে ধরতে হবে। আল জাজিরার মতো একটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে চারটি রাষ্ট্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যদি একটি মাত্র সংবাদ মাধ্যম তাদের ক্ষমতার ভীতকে এভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে তাহলে বোঝাই যায় যে তারা কোন আগ্নেয়গিরির উপর তাদের স্বপ্নের প্রাসাদ সাজিয়েছে।

তাদের চতুর্থ ভুল- হামাসকে তাদের সংকটে টেনে নিয়ে আসা। প্রথম দিকে তারা হামাস ইস্যু তোলেনি। ইরান, শিয়া এইগুলো নিয়ে ডঙ্কা পেটাচ্ছিল। কিন্তু সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়র প্যারিস এবং বার্লিনে গিয়ে যখন বুঝতে পারলেন যে, ইউরোপিয়ানদেরকে ইরানী মোয়া গিলানো সম্ভব হচ্ছেনা, তখন ইসরাইলী এবং ইয়োরোপীয় সমর্থন লাভের আশায় সচেতনভাবে হামাস ইস্যুটি যুক্ত করে দেন এবং প্যারিস থেকে ঘোষণা দেন যে, কাতারকে ইখওয়ান এবং হামাসের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। ইসরাইল এবং আমেরিকার পরে এই প্রথম কোন আরব রাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করলো। এমনকি রাশিয়াও হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। ক্ষমতার লিপ্সা তাদেরকে কতো নিচে নামিয়ে এনেছে এটা তার একটিমাত্র উদাহরণ।

কিন্তু সৌদি আরবের এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তারা ইয়রোপিয়ানদেরকে তাদের অবৈধ আবরোধের যৌক্তিকতা বোঝাতে সক্ষম হয়নি। সৌদি জোটের বক্তব্যগুলোকে তারা মোটেও আমলে নেয়নি। গোটা ইয়োরোপ বিষয়টাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিয়েছে। জার্মানি এবং স্পেন আরও আগ বাড়িয়ে তাদের এই পদক্ষেপকে কাতারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বুধবার বার্লিনে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন কাতারকে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল তখন তার মুখের উপর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্য- “মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসের উৎস সম্পর্কে আমাদের ইয়োরোপীয় সরকারগুলোর হাতে নিখুঁত তথ্য আছে। আমাদের জানা মতে বহু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থায়ন হয় রিয়াদ থেকে।” কথাটি শুনে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পুরা থতমত খেয়ে যান।

এখানে হামাসকে টেনে আনার কারণে তারা ইসরাইলী সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। নেতানিয়াহু এবং লিবারমেন কাতারের অবরোধকে সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক বলে আখ্যায়িত করে। নেতানিয়াহু বলেন- “এবার আরবদের বুঝে আসলো যে, তাদের শত্রু ইহুদীরা নয়; বরং ইসলামী জঙ্গিরাই হচ্ছে আরব এবং ইসরাইলের অভিন্ন শত্রু। এই ঘটনা আরব ইসরাইলের যৌথযাত্রার খুব ভালো একটি শুরু।”

নেতানিয়াহুর এই বক্তব্য রিয়াদ, আবুধাবি, কায়রো আর মানামার শাসকদের মুখে হয়তো এক চিলতে মুচকি হাসি ফুটিয়েছে, কিন্তু আরব জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সে ব্যাপারে কি তাদের আদৌ কোন চিন্তা আছে?! ইখওয়ানের ব্যাপারে আরবদের মাঝে বেশ বিতর্ক আছে। কিন্তু হামাসের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান অভিন্ন। তারা হামাসকে এখনও পর্যন্ত ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য লড়াই করা একমাত্র খাঁটি সংগঠন মনে করে। সেই হামাসের গায়ে সন্ত্রাসের তকমা লাগিয়ে সৌদি রাজতন্ত্র কী রাজমুকুট হাসিল করতে চায় তা মোটেও বোধগম্য নয়।

তাদের পঞ্চম ভুল- কাতারকে ফিলিস্তিনের গাজা মনে করা। কাতার গাজা নয়। যদিও আয়তনে দেশটি বেশ ছোট কিন্তু তার মিত্রের সংখ্যা প্রচুর। সামরিকভাবে প্রথম সারির শক্তিগুলোর সাথে রয়েছে তাদের বিভিন্ন সামরিক চুক্তি। ২০১১ সালে যেভাবে সৌদি নেতৃত্বাধীন জেসিসির সৈন্যরা হুড়মুড় করে বাহরাইনে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়েছিল কাতারের ক্ষেত্রেও এরকম করা সম্ভব হবে এমনটি মনে করা ছিল মুহাম্মাদ বিন সালমান আর বিন যায়দের অপরিপক্ষ চিন্তাধারা।

তবে অবরোধ যে কাতারের কোন ক্ষতি করবেনা তা নয়; বরং অর্থনৈতিকভাবে তা কাতারকে খুব দুর্বল করবে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজন হুমকির মুখে পড়তে পারে। ডলারের বিপরীতে কাতারি রিয়ালের দ্রুত দরপতন ঘটতে পারে। জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রির যোগান দিতে সরকারকে বেশ বেগ পেতে হবে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হবে কাতার এয়ারলাইন্স। কারণ আকাশ পথের অবরোধের কারণে ইয়োরোপ আমেরিকা মুখী ফ্লাইটগুলো ইরান তুরস্কের আকাশ পথ ব্যাবহার করে অনেক ঘুর পথে যেতে হবে। আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে।

তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে দুর্বৃত্ত দেশগুলো কাতারকে কখনই বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করতে পারবেনা। কাতারের হাতে রয়েছে দুনিয়ার সবচে বড় গ্যাসের মজুদ। পাশাপাশি ৩৩৫ বিলিয়ন ডলারের Sovereign wealth fund, যা তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যকে অনেকটা নিরাপদ রাখবে। শেষ কথা, কাতার টিকে থাকবে। রাজনৈতিক দস্যুগিরির যুগ আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি।

সৌজন্যে:  এনালাই্স বিডি

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

Comments are closed.